শিক্ষাখাতে বিপর্যয় বাড়ছে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ৮:৫১:০১ অপরাহ্ন
দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর এক উৎসবমুখর আনন্দঘন পরিবেশের পাশাপাশি এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতিও দেখা গেছে। স্কুল খোলার প্রথম দিনে সিলেট বিভাগের শুধু প্রাইমারী স্কুলে অনুপস্থিত ছিলো ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৭০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৫ম শ্রেণীতে অনুপস্থিত ছিলো ৫৭ হাজার ৮৬০ জন এবং ৩য় শ্রেণীতে অনুপস্থিতি ছিলো ৭৫ হাজার ৭১০জন। অপরদিকে স্থানীয় একটি দৈনিকে ‘ওরা আর স্কুলে ফিরবে না’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে দীর্ঘ দেড় বছরেরও বেশী সময় বন্ধ থাকার পর খুলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উৎসবের আমেজ শিক্ষার্থীদের মাঝে। কিন্তু মহামারি করোনা অনেক শিক্ষার্থীকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পারিবারিক অভাব অনটনে অনেকে বাধ্য হয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে উপার্জনের পথে নেমেছে। অনেকের হয়েছে বাল্য বিয়ে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের দুই শতাধিক সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোতে অর্ধ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কিন্তু করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় নি¤œবিত্ত পরিবারের অনেক শিক্ষার্থী পরিবারের রোজগারের অবলম্বন হয়ে ওঠেছে। অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে কাজ করছে পিতার কৃষিজমিতে, অনেকে জড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য পেশায়।
অপর পত্রিকার সংবাদে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ প্রায় ১৭ মাস পর সারা দেশের ন্যায় সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। কিন্তু উপজেলার বোগলাবাজার ইউনিয়নের আলমখালি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তালাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে। আরেকটি সংবাদ অনুযায়ী, গত রোববার সারাদেশের মতো সিলেটের ১ হাজার ৪৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও শুরু হয় শ্রেণী কার্যক্রম। তবে এদিনও বন্ধ ছিলো সিলেটের অনেক বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এগুলোতে ছিলো না শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি। বন্ধ ছিলো প্রতিষ্ঠানের ফটকও।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আর্থিক সংকটে পড়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। সিলেটে প্রায় অর্ধশত স্কুল করোনা সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলোর বেশীরভাগই কিন্ডার গার্টেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, সিলেট জেলায় প্লে গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে এমন বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক, এর মধ্যে করোনার কারণে সব গুটিয়ে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে অন্ততঃ ৪০টি প্রতিষ্ঠান।
উপরের সংবাদগুলোতে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার এক বেদনাদায়ক চিত্র ফুঠে ওঠেছে। এ চিত্র শুধু সিলেট নয়, গোটা দেশেরই। এ কথা অনস্বীকার্য যে, করোনা মহামারি গোটা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তবে করোনা মহামারি এবং এর ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলা ও এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেই তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে আছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ করোনাকালে ফারলো স্কীমসহ অনেকগুলো আর্থিক সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে দেশের শ্রমিক-কর্মী ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য আর্থিক সহায়তা, শিক্ষা ঋণ, বেতন মওকুফ ইত্যাদি চালু করেছে।
শুধু উন্নত দেশ নয়, প্রতিবেশী উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এ ধরণের অনেক উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলোকে। প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষাঋণ দিচ্ছে রাজ্য সরকার। এর ফলে করোনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেয়ার পাশাপাশি নির্বিঘেœ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনটাই পর্যাপ্তভাবে প্রদান করা হয়নি। করোনাকালে নাম কা ওয়াস্তে কিছু অর্থ কিছু সংখ্যক লোককে সহায়তা দেয়া হয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত স্বল্প ছিলো। যারা চাকুরী হারিয়েছেন, তাদের বেকারভাতা দূরে থাক, কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা করেনি সরকার। এ অবস্থায় তাদের সন্তানেরা ছিটকে পড়েছে পড়াশোনা থেকে। অনেক শিক্ষার্থী পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করতে বেছে নিয়েছে বিভিন্ন অমানবিক পেশা। ফলে শিশুশ্রম ও শিশুশ্রমিক বেড়েছে দেশব্যাপী।
এছাড়া এখন চাইলেও অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না, কারণ দেশব্যাপী হাজার হাজার বেসরকারী স্কুল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। মাত্রাতিরিক্ত সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাও এতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। বছর খানেক আগে করোনা সংক্রমণ যখন অনেক হ্রাস পেয়েছিলো, তখন সরকারের উচিত ছিলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া। আর তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে টিউশন ফী গ্রহণ করে কোনমতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে সক্ষম হতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শী কর্মকা-ের দরুণ মাত্রাতিরিক্ত সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে লাখো বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চিরতরে বন্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবনের ভাড়া দিতে পারেনি এবং অনেক শিক্ষক-কর্মচারী বেতন না পাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেছেন।
এ অবস্থায় দেশে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়াসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাত্রাতিরিক্ত সময় বন্ধ থাকার ফলে ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে যে ক্ষতি বা ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তা আদৌ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে কি-না, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষাক্ষেত্রে বড়ো ধরণের পরিবর্তন আনার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এ ধরণের পরিবর্ত ও পরিমার্জন যদি যথাযথ না হয়, তবে শিক্ষার্থীদের অবস্থা হবে গিনিপিগের মতো। তাই আগেভাগেই এ ব্যাপারে সতর্কতা প্রয়োজন। সর্বোপরি, শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য শিক্ষা বিভাগ তথা সরকারের উচিত সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন। অন্যথায় জাতির মেরুদন্ডরূপী শিক্ষা ভেঙ্গে পড়লে পঙ্গু হয়ে যাবে গোটা জাতি ও দেশ। আমরা এদিকে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সুদৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করছি।