শাহ আরেফিন টিলা: আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সম্ভবনাময় স্পট
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:০০:৫০ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের একেবারে পশ্চিম সীমান্তে লাল পাহাড় আর নীল পানির এক অপরূপ দর্শনীয় স্থান এখন শাহ আরেফিন টিলা। একটু পর পর লালচে আঠালো টিলার মাটি আর বড়ো বড়ো গর্তে জমে থাকা পানিতে নীল আবহ মুগ্ধ করবে যে কাউকে। মনে করিয়ে দেবে নেত্রকোনা চীনামাটির পাহাড় বিরিশিরি আর মিশরের পিরামিডের কথা। কিন্তু সকাল বিকালে পাহাড়ের গায়ে সূর্যালোকের খেলা আর অপারে মেঘালয়ের গহীন অরণ্যের হাতছানি শাহ আরেফিনে এনেছে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য। দেশের বুকে হতে পারে এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট। এর পাশেই রয়েছে দেশের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাদাপাথর।
এই টিলার চূড়ায় রয়েছে হজরত শাহ আরেফিন র. এর আসন। হজরত শাহজালাল র. এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম শাহ আরোফিন র. বাংলাদেশ সীমান্তে লাউড়েরগড় এর কাছাকাছি ভারতের মেঘালয় পাহাড়ে পাথরের গুহায় ইবাদত করতেন। কথিত আছে তিনি এসে এই টিলায় বিশ্রাম করেন, এরপর থেকে ভক্তরা এটি পাথর দিয়ে ঘিরে মাজারের মত রূপ দেন আর তখন থেকে এই টিলার নাম হয় শাহ আরেফিন টিলা। অপরূপ সৌন্দর্য আর সবুজের সমারোহে মনোমুগ্ধকর এই টিলা পাথর বোমা মেশিনের যাঁতাকলে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। একমাত্র শাহ আরেফিনের আসন ছাড়া পুরো টিলা এলাকা খোঁড়াখুঁড়িতে বিরাট বিরাট গর্তে পরিণত হয়। কদিন পরপরই এসব গর্ত থেকে শ্রমিকের লাশ বের হয়ে আসতো। ফলে এই টিলা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি হয়। এরই প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের আদেশ এখানে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে।কোয়ারি বন্ধ হওয়ায় শাহ আরেফিন পেয়েছে নান্দনিক রূপ। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাদাপাথরের কাছে বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে ভোলাগঞ্জে থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার পশ্চিমে ভোলাগঞ্জ-শাহ আরেফিন রাস্তা দিয়ে যেতে হয় শাহ আরেফিন টিলায়। সিলেটে দর্শনীয় স্থান হিসেবে এটি হতে পারে পর্যটকদের জন্য নতুন আকর্ষণ।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ৫৫ নম্বর জেএল স্থিত চিকাডহর মৌজার ১ নম্বর খতিয়ানের ৯৮ নম্বর দাগে দরগাহ শ্রেণীর ১শ ৩৭ দশমিক ৫০ একর এই জমি সরকারের পক্ষে সিলেটের জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ডভুক্ত। কিন্তু এটি দখল করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এই জায়গা পাথর কোয়ারিতে পরিণত করেন। মাটি খুঁড়ে বড়ো বড়ো গর্ত করে তারা পাথর তুলতেন এখান থেকে। বিরাট এসব গর্তে প্রায়ই ঘটতো দুর্ঘটনা, মারা যেতেন শ্রমিক। স্থানীয়রা জানান, ধুলা আর বোমা মেশিনের শব্দে একসময় এই এলাকায় থাকা দায় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালীদের দাপটের জন্য কেউ মুখ খুলতে পারতেন না। পাথর বোঝাই ট্রাক্টর চলাচলে একসময়ের পাকা সড়ক রূপ নেয় কাঁচা রাস্তায়। ফলে দৃষ্টিনন্দন স্থানটি অনেকটাই লোকচেক্ষের অন্তরালে চলে যায়। ভাঙাচোরা রাস্তা আর অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য এখানে লোকজনের আনাগোনা কম। সঠিক পরিকল্পনা আর বাস্তব পদক্ষেপ নিলে এটি হতে পারে সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি দর্শনীর স্থান। এতে বাইরে থেকে আসা লোকজনের জন্য যেমন চিত্তবিনোদনে এক নয়া মাত্রা যোগ হবে তেমনি অন্ধকারাচ্ছন্ন এই জনপদে উন্মোচিত হবে ব্যবসার নতুন ক্ষেত্র। ফলে একসময় পাথর নির্ভর এই জনপদ বিকল্প পথে পাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের আরেক পথ।
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন শাহ আরেফিন টিলায় পর্যটন শিল্প উন্নয়নে অবকাঠমো নির্মাণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। তারা এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবনায় বলা হয় শাহ আরেফিনকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তা সরকারের নতুন রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্র তৈরির পাশাপাশি বেকারত্ব দূর করতে এবং স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। শাহ আরেফিনে যাওয়ার রাস্তা অল্প হলেও বড়ো বড়ো গর্তের কারণে এখানে যাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য তাই রাস্তাটি পাকা করে একে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নিয়ে নিলে প্রায় ৫০শতাংশ কমিউনিটি বেইজড হোমস্টে গড়ে তোলা সম্ভব।
স্থানীয়রা জানান, কোয়ারি দিয়ে নষ্ট করার শাহ আরেফিন টিলা সবুজ গাছপালায় ভরা ছিল। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণক্ষেত্র ছিল এটি। টিলার চূড়ায় দাঁড়ালে চারদিকে সবুজে ঘেরা উপত্যকা, দূরে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, ধলাই নদী, ভারতীয় চুনাপাথর কোয়ারি ও চেরাপুঞ্জি, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ভারত থেকে চুনাপাথর আনার জন্য চলমান রোপওয়েসহ সুউচ্চ ভারতীয় পাহাড়ে মেঘের খেলা এবং পাহাড় ঘেঁষে বয়ে চলা ঝরণার অপরূপ দৃশ্য মানুষের হৃদয় কেড়ে নিত। বর্তমানে কোয়ারি বন্ধ থাকায় আবারো সেই আগের অবস্থায় এটি ফিরতে শুরু করছে। তারা বলেন কোয়ারি বন্ধ হওয়ায় অনেকেরই জীবিকায় টান পড়েছে। কিন্তু কোয়ারি সারাজীবন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জীবনমানেরও কোনো উন্নতি তাদের তেমন হয়নি। কোয়ারির ধুলায় বাড়িঘরের কোনো অবস্থা তাদের ছিল না। ধুলাবালিতে থাকায় সারাবছর সর্দিকাশি লেগে থাকতো। বড়ো বড়ো পাথর বোঝাই গাড়ির জন্য রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভোলাগঞ্জে যেতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হত। তারা মনে করেন রাস্তাঘাট ঠিক করে একে যদি পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে সাদাপাথরের মত একটি দর্শনীয় স্থান এটি হতে পারে। এতে কোয়ারি বন্ধ হওয়ায় যারা বেকার হয়েছেন তাদের নতুন করে সুন্দরভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। দেশে বিদেশে তাদের এলাকার নাম ছড়িয়ে পড়বে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য এলাকাটি অনেকটা দুর্গম হয়ে পড়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এসব জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে বেগ পেতে হয়। এই সুযোগে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। কাজকর্ম না থাকায় উঠতি বয়সীরা নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সবদিক বিবেচনায় টিলা ঘিরে এলাকার উন্নয়ন হলে জনগণের জীবন মানের উন্নয়নের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে বলে তারা আশা করেন।
এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমন আচার্য জানান, আমার চেষ্টা করছি, সাড়া পেতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু আমরা আশাবাদি। তিনি বলেন, শাহ আরেফিন টিলায় আগত পর্যটকদের জন্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে দর্শনার্থীরা বাংলাদেশে একখন্ড আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট দেখার স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন। এখানে বিদ্যমান ছোটো ছোটো লেকের নীল জলরাশি মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতে সক্ষম হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। এটি বাস্তবায়ন হয়ে সরকারের রাজস্ব আয়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরির পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আর্থিক ক্ষেত্রও তৈরি হবে।