পর্যটন ভাবনা : শ্রীমঙ্গল
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ অক্টোবর ২০২১, ৮:১৪:০১ অপরাহ্ন
মো. নূরুজ্জামান
চায়ের রাজধানী খ্যাত ছোট একটি শহর। মৌলভী বাজার জেলার দক্ষিণাংশে বাগান বেষ্টিত দৃষ্টিনন্দন একটি উপজেলা শ্রীমঙ্গল। ছিম-ছাম এ শহরটির সু-প্রশস্ত রাস্তা-ঘাট, দর্শনীয় স্থাপত্য শৈলীর স্থাপনা, বাড়িঘর দর্শনে এলাকার বিত্তশালীদের রুচীশীলতায় আপনার চোখ সাক্ষী হয়ে যাবে সহজেই। এ শহরের শান্তিপ্রিয় বাসিন্দারা পরস্পর অকৃত্রিম মায়ার বন্ধনে বিনা-সুতোর মালায় যেন গাঁথা এক শান্তিবাগ। এখানে ধর্ম, বর্ণ, দল-মত, জাত-পাত কোন কিছুর কমতি নেই, কিন্তু মানবতা বা সহমর্মিতাকে- “হিংস্রতা” অতিক্রম করতে পারেনি কখনো। রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, সংবাদকর্মী, জনপ্রতিনিধিরা শ্রীমঙ্গলের সম্প্রীতি ও সহাবস্থান বজায় রাখতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। শ্রীমঙ্গলে ভিজিট করবেন, তাহলে আপনি রাজধানী ঢাকা থেকে রেলওয়ের জয়ন্তিকা, উপবন,পারাবত বা কালনী এক্সপ্রেসে বৃটিশ আমলে স্থাপিত শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে জংশনে এসে নামবেন। গ্রীণ লাইন, লন্ডন এক্সপ্রেস, হানিফ, এনা পরিবাহনে এবং চাইলে নিজস্ব পরিবহনে চার থেকে পাঁচ ঘন্টায় সড়ক পথে চলে আসতে পারেন এ পর্যটন শহরে। চট্টগ্রাম থেকে দিনে দু বার পাহাড়িকা আসা-যাওয়া করে। পরিবহন সুযোগটি আপনার সুবিধা অনুযায়ী সিলেক্ট করতে পারেন। হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ খোয়াই সেতু পার হলে আপনার সামনে পড়বে সবুজ নীলিমায় চোখজোড়ানো সাতগাঁও চা বাগান। মহান মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি ও স্মৃতিবিজড়িত সাতগাঁও চা বাগানে চা কণ্যা ভাস্কর্য আপনাকে প্রথমেই স্বাগত জানাবে।
বাংলাদেশের প্রাচীনতম ছিমছাম পৌর শহরটি আপনাকে প্রথমেই আকৃষ্ট করবে। শহরটির দৃষ্টিনন্দন পৌরভবন, মহসিন অডিটোরিয়াম, জেলা পরিষদ বাংলো, মান এবং দাম নির্বিশেষে আকর্ষণীয় হেটেল-মোটেল এবং রিসোর্ট এবং সুপরিসর ও পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট সেখানকার জনপ্রতিনিধি এবং উদ্যোক্তাদের পর্যটন বান্ধব মানসিকতার পরিচয় বহন করে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, শহরে এবং পাহাড়ে বিভিন্ন মান এবং দামের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টে প্রতিদিন প্রায় পনের থেকে বিশহাজার পর্যটক এর থাকা খাওয়া এবং ট্রান্সপোর্টেশনের সুবিধা। স্থানীয় হোটেল রেষ্টুরেন্ট এবং যোগাযোগ ব্যবসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুকুল প্রভাব পড়ছে।
শহরটির পূর্ব পাশ ঘেষে দৃষ্টিকাড়া চা-বাগানে পদার্পণের আগেই আপনার দৃষ্টি কাড়বে মহান মুক্তিযুদ্ধের বেদনাময় স্মৃতি বিজড়িত শ্রীমঙ্গল বধ্যভূমি এবং এর উপর স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভ। সবুজ গালিচার বুকে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) অপরূপ সৌন্দর্য স্মারক ও সুপ্রাচীন কাল থেকে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে। শুধু শ্রীমঙ্গল উপজেলায় চল্লিশটি চা বাগানের অবস্থান শহরটিকে চায়ের রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছে।
দিগন্তজোড়া কাঁচা সবুজগালিচায়,দর্শককে অবাক চেয়ে থাকতে হয় ! কয়েক কিলোমিটার এগুলেই ” গ্র্যান্ড সুলতান টি-রিসোর্ট এন্ড গল্ফ” দেশ-বিদেশের সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য নিরাপদ,নিরিবিলি রুচিমাখা অনন্য স্থাপনা সেটি। অর্ধ কিলোমিটার সামনে এগোলে আপনি হারিয়ে যাবেন শতবর্ষী হাজারো গাছালিতে ঠাসা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। শতবর্ষী গগনচুম্বী চিরহরিৎ হাজার প্রজাতির গাছ, হাজার প্রজাতির বন্যপ্রাণী, সরীসৃপ এর সহাবস্থানের অনুপম দৃশ্য এ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আপনি চাইলেই উপভোগ করতে পারেন। ঘন অরণ্যে সাহস করে ঢুকে গেলে অথবা লাউয়াছড়া বুক চিড়ে সমান্তরালে বয়ে যাওয়া রেল লাইন ধরে সবুজে হারিয়ে গিয়ে দলবদ্ধ নানা প্রজাতির বানর দলের সবুজ গালিচার সংবর্ধনা আপনি পেতে পারেন!
উদ্যানঘেষা ডান দিকের পথটি আপনাকে আরও সবুজ গহীনের হাতছানিতে মায়াবী ডাক দিবে। চা-বাগানের পাশপাশি শতশত লেবু ও আনারস বাগান যেন সবুজ ও সজিব অর্থনীতির সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। কাঁঠাল,কলা, আনারস, পেঁপে, মালটা, নাগামরিচ আরো কত কি ফলছে বাগান গুলোতে। বনোপথের দু ধারে দেখতে পাবেন অনেকগুলো প্রকৃতিঘেরা বাহারি নামের চোখজোড়ানো কটেজ বা কুটির। সাহস করে একটি রাত এ ঘনবনে হুতোমপেঁচা, জোনাকিদল ও ব্যাঙ ডাক উপভোগ করে যেতে পারেন! ঘুরতে-ঘুরতে আপনি আর একটি মনকাড়া সবুজ সৌন্দর্য স্মারকের দেখা পেয়ে যাবেন।
প্রকৃতির গহীনে “লেমন গার্ডেন রিসোর্ট” শ্রীমঙ্গলেরই এক তরুণ উদ্যোক্তার রুচীভরা মনের মাধুরী মিশানো স্থাপনা। শহুরে ইট- পাথরের নিরস জীবনকে অন্তত দু-একদিনের তরে রসপূর্ণ করে ছাড়বে- সন্দেহাতিত ভাবে কথাটি জোর দিয়েই বলতে পারি। আপনার সন্তানদের নিয়ে একবার ঘুরে দেখে যেতে পারেন।
লাউয়াছড়ার মাঝ দিয়ে কমলগঞ্জ রোডের নিবিড় প্রকৃতির মাঝে সু উচ্চ টিলা গুলোতে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে। শ্রীমঙ্গল ও কমলাগঞ্জের বিভিন্ন মনিপুরী পল্লীতে দেখতে পাবেন সরলমনা মনিপুরী রাজা ও মন্ত্রী পাড়া। মনিপুরী পানের বরজ ও কুটির শিল্প আপনাকে আকৃষ্ট করবে। শ্রীমঙ্গল থেকে কমলগঞ্জ গিয়ে ডান দিকে মোড় নিয়ে এগিয়ে যান, দেখবেন মনিপুরী লালিতকলা একাডেমী। কয়েক কিলোমিটার এগোলে আবার ডান দিকে মোড়, সামনে গিয়ে দেখবেন ন্যাশনাল টি গার্ডেনের সবুজ এবং পাহাড়বেষ্টিত ‘মাধবপুর প্রাকৃতিক লেক’। লাল-সাদা শাপলা এবং জলজ উদ্ভিদের সমাহারের বিশাল মাধবপুর লেকের নীলাভ পানিধৌত মিষ্টি বাতাস এ সবুজ ভুবনে আপনার দেহ-মনে প্রশান্তির শিহরণে দোলা দিবে।
আপনি কমলগঞ্জের এ রাস্তাটিতে সীমান্তঘেষা বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের সমাধিসৌধে যাওয়ার ডিরেকশন পেয়ে যাবেন। আপনি যদি একটি পরিশ্রমী এবং উদ্যমী থ্রিলার মানিসকা ধারণ করেন, সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার অদুরে হাম-হাম জলপ্রপাতে গোসল সেরে আসতে পারেন।
শ্রীমঙ্গল শহরের পশ্চিম দিকে এগিয়ে যান! সিএনজি অটোরিকশায় গ্রামীন রাস্তার শেষ মাথায় “হাইল হাওর” তার বিশাল হৃদয় উজাড় করে হাতছানিতে ডাকছে। ভরা বর্ষায় টইটুম্বুর। শত-শত মৎস্যখামারের মাঝে জলঅর্থনীতির অযুত সম্ভাবনা আপনি দেখতে পাবেন। শহরের কয়েক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বরুনা মাদ্রাসা রাস্তার শেষ দিকে এগোলে দেখবেন মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের অভয়াশ্রম বাইক্কাবিল। ঋতুবৈচিত্র্যের শীতের শুরুতে গেলে দেখবেন হিজল-করচের সবুজবেষ্টনীতে হাজারো সাইবেরিয়ান অতিথিপাখি এবং বালিহাসের সরব মিলন মেলা। এদের কিচিরমিচির আপনার ভাবুক মনকে উথালা করে ছাড়বে। ঢালাকৃতির লাল-নীলাভ এবং সবুজ শাপলা পাতা এবং হাজার প্রকৃতির জলজ উদ্ভিদের মাঝ থেকে নিশ্চিন্তে এবং তৃপ্তিভরে নেয়ে-খেয়ে-গেয়ে নির্মল আনন্দে সময় কাটাচ্ছে সে অতিথি পাখির দল। আসা-যাওয়ার পথে দেখবেন ব্যক্তি পর্যায়ে গড়ে উঠা শত-শত মৎস্য খামার, যে গুলো দেশের জিডিপিকে সমৃদ্ধ করছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সরকারি প্রণোদনায় পর্যটনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানসহ নিজ দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সেসব দেশে পর্যটনখাত বিকাশে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা ও প্রণোদনা দিয়ে থাকে। শ্রীমঙ্গলের উদ্যোক্তা সূত্রে জানা যায়,পর্যটন বিকাশে উল্লেখকরার মতো সরকারি কোন সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। বরং প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সে খাত জর্জরিত। করোনা মহামারী স্থানীয় পর্যটন খাতকে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করে ফেলেছে। সংশ্লিষ্ট সবাই সরকার বা মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছে। সমাজ চিন্তকদেরও কিছু পরামর্শ এবং উপদেশ পর্যটন উদ্যোক্তাদের প্রতি আছে। যেহেতু পর্যটন উদ্যোগ একটি সুন্দর ও সৃষ্টিশীল ব্যবসা। সেখানে সমাজ ও সংস্কৃতি কলুষিত হয় এমন কদর্যতা থেকে যেন সকলে সযতন ও সচেতন থাকেন। শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফেরার সময় আপনি অর্গানিক স্থানীয় ফল যেমন – কাঁঠাল, কলা, আনারস, লেবু, চা পাতা সুলভ মূল্যে সাথে নিয়ে যেতে পারেন। শ্রীমঙ্গলের বেড়াতে আসতে চাইলে সম্ভব হলে কোন বাগান মালিক বা ব্যবস্থাপকের সাথে আগেই যোগাযোগ করে আসতে পারেন। প্রায় প্রতিটি রিসোর্টে অনলাইনে বুকিং চলে। তাছাড়া প্রতিটি হোটেল বা রিসোর্টে গাইড বা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নির্দেশনা বিদ্যমান। পরিবার নিয়ে আসলে নিরাপত্তা নির্দেশনা গুলো ভালকরে দেখা জরুরী। ট্যুরিষ্ট পুলিশের যোগাযোগ নম্বর আপনি আপনার মোবাইলে সেইভ করে রাখতে পারেন।