দর্শনার্থী ও ভ্রমণ পিপাসুদের নতুন ঠিকানা ফেনারবাঁক নলচুন্নী করচ বাগান
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২১, ৬:২৯:২৪ অপরাহ্ন
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, জামালগঞ্জ : সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক নলচুন্নী নয়নাভিরাম করচ বাগান অবসরে দর্শনার্থী ও ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। বর্ষায় যে দিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি, হেমন্তে সবুজের সমারোহের মাঝখানে ঐতিহ্যবাহী নিভৃত পল্লীগ্রাম ফেনারবাঁক নলচুন্নী কান্দায় ঘেঁষে ঘেঁষে তৈরী করা হয়েছে এই করচ বাগান। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দিগন্ত বিস্তৃত যে জলাভূমি রয়েছে, বছরের ছয় মাস সেখানে জলের রাজত্ব আর ছয় মাস ফসলের আনন্দ। এখানকার হিজল-করচ বাগে বসে অতিথি পাখির মেলা। পাহাড় ঘেরা আর হাওর বেষ্টিত এই জনপদের নাম সুনামগঞ্জ। দেশের আট-দশটা জনপদ থেকে একেবারেই ভিন্ন। এখানকার হাওরের প্রাণী, উদ্ভিদের বন ও মৎস্য সম্পদ পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে অবদান রাখছে।
লাল-সবুজের এই বাংলাদেশে প্রকৃতির অপরূপ মনোরম দৃশ্য পাহাড়ি অঞ্চল, সুন্দরবন, আর সমুদ্র সৈকতে দেশী-বিদেশি পর্যটকদের যেমন হৃদয় আকৃষ্ট করে, তেমনি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার হাওরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পল্লী ফেনারবাঁক গ্রামের পিছনে নলচুন্নী খাস কান্দায় পরিবেশবাদী সংস্থা সিএনআরএস এর রোপায়িত করচ বাগান সৌন্দর্যের অপার লীলাভুমি ও নয়নাভিরামে দর্শনার্থী ও ভ্রমন পিপাসুদের ভীড়ে মুখরিত হয়ে উঠছে। অবসরে হাওর পাড়ের প্রকৃতি উপভোগ করতে দেশের ভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসছেন বিভিন্ন শ্রেণীপেশার ভ্রমণ পিপাসু হাজার হাজার মানুষ। জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক গ্রামের পাশেই অবস্থিত এই হিজল-করচ বাগান। গেল বসন্তে গ্রামের কৃতী সন্তান শাহরিয়ার চৌধুরী বিপ্লব গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে বিনোদনের এই ষ্পটটি নান্দনিক ও আকর্ষণীয় ষ্পটে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছেন।
ফেনারবাঁক ইউনিয়নের চিরচেনা ¯্রােতস্বিনী ‘কানাইখালী নদী’র বাঁকে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে করচের অপরূপ বাগান এখন মনোমগ্ধুকর পরিবেশ সৃষ্টি করে তুলেছে। ষড়ঋতুর সকল মাসেই প্রকৃতিপ্রেমি ও ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকে কানাইখালী নদীর তীর। বিগত কয়েক বছর ধরে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযু্িক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, এমসি কলেজ, মেট্টোপলিটন ইউনিভাসিটি, মদন মোহন কলেজ, লিডিং ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিনিধি দল হাওরের এই আকর্ষনীয় কানাইখালীর তীরে নলচুন্নী করচ বাগান ভ্রমনে আসেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা জামালগঞ্জের শিক্ষার্থীরা সরকারী বেসরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, প্রবাসীরা একত্রিত হয়ে কনাইখালী নদীর তীরে এই মনমোগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা করেছেন। প্রকৃতির প্রেমে বিমোহিত হয়ে সবাই দাবি করছেন এই অঞ্চলকে সরকারীভাবে দৃষ্টি দিয়ে এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যখন চিন্তাবিদদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, তখন আমাদের মত ছোট্ট জনবহুল দারিদ্র দেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের রোধে কতটুকু ভূমিকা রাখছে তা সহজেই অনুমেয়।
সুনামগঞ্জের হাওর বেষ্টিত পশ্চাৎপদ জামালগঞ্জ উপজেলা। ৩৩৮.৭৮ বর্গ কি.মি আয়তনে প্রায় দুই লাখ লোকের বসবাস। ‘মাছ আর ধান এই এলাকার প্রাণ’। এক সময় পুরো হাওরাঞ্চলে ছোট ছোট নদী নালা, খাল, বিল, ডোবার তীর ঘেঁষে অবস্থান ছিল হিজল করছ গাছসহ নানাবিধ জলজ উদ্ভিদের। বর্ষায় ওইসব গাছ জলজ উদ্ভিদ যখন জলে ডুবে যেত, তখন অসংখ্য প্রজাতির মৎস্যের অভয়াশ্রম ছিল। প্রজাসত্ব আইনে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে, স্থানীয় জমিদারগন ওই সব গাছ পালা কেটে উজার করে মরুময় করে দেয় এই অঞ্চলকে। ১৯৬০ দশক থেকে বিত ৫০ বছর পর্যন্ত ছিল বৃক্ষ শূন্য এই হাওর এলাকা।
প্রায় দেড় যুগ পূর্বে হাওরাঞ্চলকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে পরিবেশবাদী সংস্থা সেন্টার ফর ন্যাচারাল রির্সোস ষ্ট্যাডিজ (সিএনআরএস) কাজ করে যাচ্ছে হাওর এলাকায়। সিএনআরএস’র একটি প্রকল্প ন্যাচারাল রির্সোস গভর্ন্যান্স (এনার্জি) বিভিন্ন এলাকায় সমাজভিত্তিক সংগঠন সিবিওকে সংঘটিত করে। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর হতদরিদ্র মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠা সহ সম্পদের সুষম বন্টন তৈরীতে ভুমিকা রাখে। পরিকল্পিত আহরণ ও সংরক্ষণ করার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রয়েছে হাওরের নিভৃত পল্লী লোতে। উপজেলার প্রায় ১০ টির’ও বেশি ষ্পটে সরকারী পতিত খাস কান্দা ও রেকর্ডীয় ৮৩ একর ভূমিতে দুই লক্ষাধিক হিজল-করছ গাছের চারা রোপন করে পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সিএনআরএস। উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের বিনাজুরা গ্রামে ৩.১৮ একর ভূমিতে ১১ হাজার, মাতারগাঁও গ্রামে ১১ একর ভূমিতে ১২ হাজার হিজল-করচ, ছয়হারা গ্রামে ১৭ একর ভূমিতে ১৭ হাজার, ফেনারবাঁক গ্রামের নলচুন্নী কান্দায় ১৫ একর ভূমিতে ১৪ হাজার, খোঁজারগাও গ্রামে ১০ একর ভূমিতে ১০ হাজার, ভাটি দৌলতপুর গ্রামের আওতায় ৩ একরে ১২ হাজার ও সাচনা বাজার ইউনিয়নে রহিমাপুর-হরিপুর গ্রামের বাগানে ১০৩ একর ভূমির মধ্যে ২২ একর ভূমিতে ২৩ হাজার হিজল- করচ গাছ রোপন করা হয়েছে এই সংস্থার পক্ষ থেকে। এই হিজল-করচ গাছগুলো বর্ষায় হাওরের প্রচন্ড ঢেউ থেকে নিভৃত পল্লীর বসতি গ্রাম গুলোকে রক্ষায় সহায়তা করে। বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্যের অভয়াশ্রম বা অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। হিজল করচ বাগানগুলোতে এখন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় দিনি দিন পর্যটক ও ভ্রমন পিপষুদের পদচারনার মুখরিত হয়ে উঠেছে। আগত শীতে সাইভেরিয়ার বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি হাওরের এই বাগানে কিছির মিছির সুর তোলছে।