চিকিৎসা বনাম অপচিকিৎসা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০৪:২২ অপরাহ্ন
গতকাল দৈনিক জালালাবাদে ‘অপচিকিৎসায় বছরে ২৬ ভাগ মানুষ শারীরিকভাবে অক্ষম হচ্ছেন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে এদেশের স্বাস্থ্য সেবা খাতের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুল বা অপচিকিৎসায় প্রতি বছর এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে অপচিকিৎসার শিকার শত শত মানুষ। আবার সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া মানুষের সংখ্যা ও কম নয়। এসব কারণে বছরে অসুস্থ মানুষের একটি বড়ো অংশ অর্থাৎ প্রায় ২৬ শতাংশ মানুষ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাসিস্টিক্স-২০২০ তে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে ৯ জন কোন না কোন কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম। তাদের মধ্যে ৩.২ শতাংশ সঠিক চিকিৎসার অভাবে বা ভুল চিকিৎসার কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। এছাড়া অজ্ঞাত অসুখের কারণে অক্ষম হচ্ছেন ২৩ শতাংশ মানুষ। জরীপে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ জন্মগত কারণে, ৯ শতাংশ দুর্ঘটনায়, ১১ শতাংশ মানুষ বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হন। এদের মধ্যে পুরোপুরি অক্ষম ২৯ শতাংশ। ৪৩ শতাংশের অক্ষমতা জটিল পর্যায়ে রয়েছে এবং ২৮ শতাংশের অক্ষমতা মৃদু পর্যায়ের। ভুল চিকিৎসায় ৩.২ শতাংশের শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার ব্যাপারে ‘ভুল চিকিৎসা’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন চিকিৎসকেরা। তাদের মতে, চিকিৎসা যে ভুল দেয়া হয়েছে সেটা এক কথায় বলে দেয়া যায় না। হতে পারে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া পক্ষাঘাত, বাত রোগ, আগুনে পোড়া, সড়ক দুর্ঘটনা, বার্ধক্যসহ নানা করণে শারীরিক অক্ষমতার সৃষ্টি হয়। সঠিকভাবে সঠিক সময়ে এসব রোগের চিকিৎসা শুরু করা না গেলে এসব সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। শতকরা ৬০ শতাংশ মানুষ এখনো অনানুষ্ঠানিক চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।
সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুসারে, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ওষুধের দোকান, হাতুড়ে চিকিৎসক ও নিজে নিজে চিকিৎসা গ্রহণ করে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ। মাত্র ৩ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ পেয়ে থাকে। আর রোগ পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে সেবা প্রত্যাশীরা মাত্র ১৫ শতাংশ পরীক্ষার সুবিধা পায়। ফলে মূল অংশটিকে নির্ভর করতে হয় বেসরকারি পরীক্ষাগার বা প্যাথলজিক্যাল সেন্টারের ওপর। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের উপরের বর্ণিত চিত্রটি রীতিমতো শঙ্কা সৃষ্টিকারী। সরকারি বাগাড়ম্বর ও সাফল্যের দাবি সত্বেও যে দেশের সিংহভাগ মানুষ সরকারি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত, সেদেশে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষের অসুস্থতাসহ অন্যান্য কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষভাবে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ এখনো সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা সেবার বাইরে। নিশ্চিতভাবেই চিকিৎসার সুষ্ঠু সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় তারা হাতুড়ে চিকিৎসক ও নিজে নিজের চিকিৎসার আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। অবশ্য এক্ষেত্রে কিছু মানুষ অসচেতনতা ও গাফিলতির কারণে আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী হচ্ছে না। সর্বোপরি, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। একেতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভাব, ওষুধের অপর্যাপ্ততা, আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জমাদির অভাবের পাশাপাশি অসচেতনতা ও অজ্ঞতা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক। বিনা প্রয়োজনে বা অতিরিক্ত ওষুধ সেবন এবং ওষুধের পাশর্^প্রতিক্রিয়া এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে অধিকতর অসুস্থতা কিংবা শারীরিক অক্ষমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিভিন্ন উন্নত দেশের চিকিৎসকরা পারতপক্ষে রোগীদের ওষুধ দেন না। চেষ্টা করেন খাদ্যভ্যাস পরিবর্তন ও ফিজিওথেরাপীসহ বিকল্প পন্থায় চিকিৎসার। কিন্তু এদেশের অধিকাংশ চিকিৎসক রোগীদের এক গাদা ওষুধ ও টেস্ট দিয়ে থাকেন। ফলে ওষুধে যতোটা রোগ সারে, ততোটা দুর্বল করে ফেলে পাশর্^ প্রতিক্রিয়ার দ্বারা। এ অবস্থায় বিদেশে গৃহীত অলটারনেটিভ মেডিসিন, আয়ূর্বেদী, হেকিমী চিকিৎসা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সহ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ভুল ও অপচিকিৎসা, ওষুধের পাশর্^প্রতিক্রিয়া ও অসচেতনতার ক্ষেত্রে এই বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি সুফল বয়ে আনতে পারে। এদিকে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি দেয়া উচিত।