গুরুত্ব হারাচ্ছে মূল ধারার মিডিয়া!
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ৮:৩৯:৩৩ অপরাহ্ন
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত এক সভায় বক্তারা বলেছেন, ব্যবসায়িক স্বার্থ ও শক্তিশালী বিভিন্ন মহলের প্রভাবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম তার স্বাধীনতার হারাচ্ছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও নানামুখী চাপ তৈরি করা হচ্ছে। এতে বলা হয়, এদেশে গণমাধ্যমের উত্থান ও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিককরণ হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩২টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে ৪৮টি গণমাধ্যম। এসব পত্রিকা মালিকদের স্বার্থের ঢাল হিসেবে কাজ করছে।
এতে আরো বলা হয়, গণমাধ্যমের লাইসেন্স পাওয়া নির্ভর করছে সরকারের সাথে সম্পর্কের ওপর। কমপক্ষে ২০টি আইন, ধারা ও নীতিমালা মিডিয়ার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে। এ কারণে দেশে বহু গণমাধ্যম গড়ে ওঠলেও পেশারিত্ব নিশ্চিত করা যায়নি। সভায় আরো বলা হয়, দুর্নীতি প্রতিরোধে সাংবাদিকতার জন্য যে পরিবেশ দরকার, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের সোচ্চার হওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব সরকারেরও। কিন্তু এখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে।
উপরোক্ত বক্তব্যে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর বর্তমান চালচিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে। সংবাদপত্রকে বলা হয় ফোর্থ ইষ্টেট। বলা হয়, জাতির দর্পণ। আর সাংবাদিকদের বলা হয়, জাতির বিবেক। কিন্তু জাতির এই দর্পণে যদি আলকাতরা মেখে দেয়া হয়, তবে তাতে কিছুই প্রতিফলিত হবে না। অর্থাৎ দেখা যাবে না। বর্তমানে জাতির দর্পণ স্বরূপ সংবাদসহ বিভিন্ন মিডিয়া নানা আবিলতায় আচ্ছন্ন বা কালিমালিপ্ত হয়ে পড়েছে। ফলে এদেশের প্রকৃত চিত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এসব মিডিয়ায়।
বলা বাহুল্য, এদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল ব্যক্তি, দলীয় ও বিভিন্ন চ্যানেল ব্যক্তি, দলীয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে পরিচালিত হওয়ায় এগুলোতে এখন জনজীবনের প্রকৃত চিত্র, সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ও আশা আকাঙ্খার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটছে না। একইভাবে স্বার্থে এগুলোর অধিকাংশ সাংবাদিকও পত্রিকা ও চ্যানেল মালিক বা মালিকগণের স্বার্থে তাদের পক্ষ হয়ে সাংবাদিকতা করছেন। এতে সাংবাদিকতার মহতী পেশা হচ্ছে কলংকিত, হারিয়ে যাচ্ছে এর নিয়মনীতি ও ঐতিহ্য। এ অবস্থায় পাঠক সমাজ তথা জনগণ প্রকৃত তথ্য ও চিত্রের জন্য শরণাপন্ন হচ্ছেন বিকল্প মিডিয়ার। ফলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষভাবে ফেইসবুক এবং অনলাইন পোর্টালসমূহ। এভাবে মেইন স্ট্রিম অর্থাৎ মূল ধারার সাংবদিকতা তার শক্তি, সাহস ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কারেন্ট বা চলমান ঘটনা ও তথ্যের জন্য মানুষ বিপুলভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভর করছে। তাৎক্ষণিক সংবাদের জন্য ফেইসবুকের চেয়ে ভালো সংবাদ মাধ্যমে এখন আর একটিও নেই এদেশের সাধারণ মানুষের কাছে। তবে এর কিছু খারাপ দিকও আছে। ফেইসবুকে প্রায়ই অনেক মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সংবাদ প্রকাশিত হয়। যে কেউ ফেইসবুক সাংবাদিক হয়ে তা প্রকাশ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও একটি সমাধান আছে। ফেইসবুকে বিভিন্ন জনের একাউন্টের নিউজ যাচাই করলে প্রকৃত সত্যটি বের করে আনা সম্ভব।
মূলধারার সাংবাদিকরা সত্য ও প্রকৃত সংবাদ প্রকাশের জন্য প্রায়ই ঝুঁকি ও বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। প্রকাশিত তথ্য ও সংবাদে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি হালে প্রায়ই সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষেপে ওঠতে দেখা যায়। একইভাবে কোন সংবাদ বা তথ্য সরকারি কর্মকর্তা বা ক্ষমতাসীন নেতানেত্রীদের বিপক্ষে গেলে তাদের চক্ষুশূল হতে হয়, রোষের মুখে পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও মিডিয়াকে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রণীত আইন তাদের বিরুদ্ধে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। এভাবে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বলি হয়ে এদেশের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিককে কারারুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত অনেক লেখক-সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে কারাগারে।
সর্বোপরি বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অধিকাংশ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মালিক ক্ষমতাসীন দলের বা তাদের ঘনিষ্ট লোকজন হওয়ায় সরকারের গুণ কীর্তনই তাদের প্রধান কাজ ও দায়িত্ব হতে দেখা যাচ্ছে। ফলে জনগণের দুঃখ কষ্ট ও দুর্ভোগের কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে এসব চাপাবাজি, মিথ্যে বাগাড়ম্বর ও গুণকীর্তনের ডামাঢোলে। তাই ভরা মৌসুমে প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম বাড়লেও কিংবা করোনার দোহাই দিয়ে অযথা মাসের পর মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেও কোন মিডিয়া বা সাংবাদিকদের প্রতিবাদী বা সোচ্চার হতে দেখা যায় না। বরং ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাধরদের অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে। এভাবে মিডিয়া হারাচ্ছে তার গুরুত্ব ও ঐতিহ্য।