সড়কে আলোর নৈরাজ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ৭:০৪:১৮ অপরাহ্ন
মোশাররফ হোসেন সবুজ
নব্বইয়ের দশকে আমরা স্কুলছাত্র। ছোট্ট শহরগুলো তখনো পৌরসভায় উন্নিত হয়নি। কার মাইক্রোবাসের প্রাচুর্য নেই। তিনচাকার টু-স্ট্রোক অটোরিক্সা আছে অল্প-স্বল্প। দুই টাকা টাউনট্রিপের রিক্সাই তখন ছোট্ট শহরগুলোতে মানুষের চলাচলের প্রধান ভরসা। হর্ন নেই, শহরজুড়ে রিক্সার টুংটাং শব্দ। রাতের বেলা রিক্সার নিচে চেসিসের রডের সাথে কেরোসিনের লন্ঠন বেঁধে রিক্সাগুলোকে চলতে হতো যাতে অন্ধকারে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য। ৪-৫ টাকা লিটারের কেরোসিন কিনে নিয়মিত লন্ঠন জ্বালিয়ে রিক্সা চালানোর কাজ যে দরিদ্র রিক্সাচালক সবসময় খুব উৎসাহের সাথে করতেন, এমন নয়। মাঝেমধ্যেই রিক্সায় বাতি জ্বলতো না। কিন্তু যেহেতু নজরদারি ছিল, কর্তৃপক্ষ শহরজুড়ে মাইকিং করে রিক্সাচালকদের সতর্ক করে দিতেন, না হলেতো জরিমানা। রাতের বেলা আবার সবগুলো রিক্সায় আলো ঝুলতে দেখা যেতো। দিন গড়িয়ে এখন ২০২১। আলোর বিপ্লব ঘটেছে। কোথায় নেই আলো! চটপটি বিক্রেতার কাছে এখন কেরোসিনবিহীন ফকফকা আলো। মাছের বাজারে মাছের ডালার উপর ঝুলে থাকা এলইডি বাল্বের আলোয় রুপালী ইলিশ এর গায়ের আঁশ আরো রূপালী হয়ে ওঠে এখন। কিন্তু আলো থাকা খুব জরুরি যেখানে, সেখানেই অনেকসময় আলো নেই। এই জনবহুল দেশে হুহু করে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। দিনে গাড়ি, রাতে গাড়ি। রাতে গাড়ি চালাতে বাতি লাগবেই। ব্রেক লাইট, সিগনাল লাইট বা ব্লিংকারের মত বাতিগুলো দিনেও লাগে। এতো এতো গাড়ির মধ্যে সবগুলো লাইট বা বাতি ঠিকঠাক আছে এমন গাড়ি খুব কম। ব্রেক করলেও ব্রেকলাইট জ্বলেনা -কোনো সংকেত ছাড়াই রাস্তায় ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায় গাড়ি। যেনো নেই কোনো দায়দায়িত্ব। দুর্ঘটনা ঘটে, মানুষ অনেক সময় আহত হয়, জীবন দেয়।
রাতের বেলা একটি হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চলতে দেখা যায়। বিশেষ করে শুধু বামপাশের হেডলাইট জ্বালিয়ে চলা গাড়িগুলো খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। বিপরীত দিকে আসা গাড়িচালক ভাবেন, সামনে মোটরসাইকেল আসছে। গাড়ির আকার কী, গাড়িটি রাস্তার কতটুকু জায়গা জুড়ে আছে, অন্য চালক তা আন্দাজ করতে পারেন না। দুর্ঘটনা তখন খুব সম্ভাব্য একটি বিষয়।
বাতিহীন গাড়িগুলো যেমন বিপজ্জনক, অতিরিক্ত বাতিযুক্ত গাড়িগুলোও সড়কে বিভ্রান্তি তৈরি করে, বিপদের একটি অনুষঙ্গ হতে পারে। অনেক চালক আছেন, গাড়ির সাথে থাকা বাতিগুলোতে তারা তৃপ্ত নন, তাদের আরো বাতি চাই, বাড়তি ফগলাইট তারা লাগিয়ে নেন। মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিক্সা এমনকি বাস-ট্রাকেও অতিরিক্ত বাতির আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়। গাড়িতে ফগলাইট লাগানোর সময় যেহেতু পজিসনিং বা এ্যালাইনমেন্টের বালাই থাকে না, এলোমেলো ফোকাস থাকে, ফগলাইটের আলো তাই বিপরীত দিক থেকে আসা চালকের দৃষ্টিসমস্যার সৃষ্টি করে। ফলে, দুর্ঘটনার জন্য অনুকূল একটি পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মোটরসাইকেল এবং সিএনজি অটোরিক্সার ফগলাইট বা এলইডি লাইটগুলো বিপরীত দিক থেকে অগ্রসরমান চালকের জন্য অসুবিধা তৈরি করে।
ট্রাকবাসগুলোও এখন অতিরিক্ত বাতি লাগিয়ে চলে। ট্রাকের সামনে বাম্পারের নিচের অংশে তারা যে অতিরিক্ত লাইটগুলো ব্যবহার করেন সেগুলোর আলো হেডলাইটগুলোর চেয়েও বেশি এবং তা অন্যান্য যানবাহনের জন্য রাতের বেলা অসুবিধার একটি কারণ। অনেক সময় হেডলাইট বন্ধ করে ঝুলিয়ে দেয়া লাইটের আলোয় তারা গাড়ি চালান। ফলে গাড়ির আকার সম্পর্কে এখানেও বিপরীত দিকের চালকেরা দ্বন্দ্বে পড়েন। ট্রাক-বাসগুলোতে প্রায়ই নীল, হলুদ, সবুজসহ বিভিন্ন রংয়ের বাতি গাড়ির চারপাশে লাগিয়ে দিতে দেখা যায়। কিন্তু লাল এবং নীল রংয়ের বাতিতো জরুরি পরিস্থিতি নির্দেশ করে। রোগীবহনকারী এ্যাম্বুলেন্স এবং পুলিশের গাড়িতে লাল-নীল বাতি দুনিয়াজোড়া ব্যবহার করা হয়। সবুজ বাতি ডাক্তার বহনকারী গাড়ির জন্য। আমাদের রাস্তাঘাটে এগুলো ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা হচ্ছে। অতিরিক্ত বাতিযুক্ত গাড়িগুলো অন্যান্য চালকের জন্য দৃষ্টিগত এবং মানসিক বিভ্রান্তি তৈরি করতে ভূমিকা রাখে। বিভ্রান্ত চালক সহজে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারেন।
এ্যাম্বুলেন্সে যেভাবে লাইট ফ্লাশ করা হয়, কিছু কিছু গাড়িতেও এখন ফ্লাশলাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে একটি প্রাইভেট কারকে হেডলাইট ফ্লাশ করতে করতে চলতে দেখলাম। এও সম্ভব!
আলোর ব্যাপারে অশিক্ষিত চালকেরা স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিচ্ছেন। চালকেরা স্বেচ্ছাচারী হতে পারেন। তাই, যে কোনো ধরণের স্বেচ্ছাচার বা নৈরাজ্যকে প্রতিরোধ করার জন্য বা দমন করার জন্য বা প্রতিহত করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে। নাগরিক হিসাবে আমার একটি প্রশ্ন আছে, আমরা সাধারণ নাগরিকেরা যখন এগুলো নিয়ে সমস্যায় ভুগি তারা তখন এগুলো দেখতে পান না কেনো ? দেখতে পেলে আলোর এ নৈরাজ্য চলছে কীভাবে! সড়ক দুর্ঘটনায় এতো এতো প্রাণ ঝরে যায় এ দেশে, যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে তাদের অবস্থাতো আরো শোচনীয় – চিকিৎকসার খরচ যোগাতে যোগাতে পুরো পরিবার পথে বসে যায়। সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু, জখম, পঙ্গুত্ব- আলোর এমন নৈরাজ্য নিশ্চয়ই একটি কারণ। আমরা এর অবসান চাই।
লেখক: কলেজ শিক্ষক