শ্রদ্ধাঞ্জলী: সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ৬:৫৩:২১ অপরাহ্ন
ড. মোহাম্মদ আবু তাহের
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মজিদে ঘোষণা করেন, যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করলেন, তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে কে শ্রেষ্ঠ তা পরীক্ষা করার জন্য। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল। (সুরা মুলক আয়াত ২)
২৫ ডিসেম্বর ২০২১ শনিবার ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন খ্যাতিমান সিনিয়র সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ১৯৪৫ সালে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার নারান্দী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে অর্থনীতিতে এম.এ ও ১৯৭২ সালে এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ‘দ্যা ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ ও ‘দ্যা নিউজ টুডে’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এর আগে ‘দ্যা ডেইলি স্টার’ এর উপ-সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ জাতীয় প্রেসক্লাবের চার বারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন। দল-মত-নির্বিশেষে সাংবাদিক সমাজের কাছে তিনি ছিলেন এক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। এ ধরনের একজন মানুষ চলে যাওয়ায় সাংবাদিক সমাজে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ হবে কিনা জানিনা।
অসাধারণ নেতৃত্বগুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। সাংবাদিক সমাজের দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সম-সাময়িক বিষয় নিয়ে তিনি নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ পেশাগত জীবনে একজন সফল মানুষ ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় যোগদানের মধ্য দিয়ে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন। এর আগে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। তিনি কিছুদিন ঢাকার হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ ও টাঙ্গাইলের কাপাসিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৭০ সালে সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী সদস্য হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এবং ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন তিনি। একাত্তরের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রিয়াজউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আবার বাংলাদেশ অবজারভার-এ যোগ দেন।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি অভজারভারের প্রধান প্রতিবেদক সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। রিয়াজউদ্দিন আহমেদ সার্কভুক্ত দেশগুলোর সাংবাদিকদের ফেডারেশন সমন্বয়ে গঠিত দক্ষিণ এশিয়া সংবাদিক সমন্বয় পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সাউথ এশিয়া ফ্রী মিডিয়া এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক। এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মানুষ ছিলেন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সৃজনশীলতার জন্য দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন মানুষের মধ্যে। তার লেখনীতে দেশ ও জাতি উপকৃত হয়েছে। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ঘটনা মানুষের মৃত্যু, মানুষ একটা নির্দিষ্ট জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আসে, এরপর চলে যায় চিরদিনের জন্য। এ পরিণতি থেকে কারো রেহাই নেই। কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে মহামানব পর্যন্ত সবাইকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হয়।
মৃত্যু নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের অনেক আক্ষেপ ছিল, কষ্ট ছিল, তার শেষ লেখাগুলোতে ছিল বেঁচে থাকার আকুতি। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, একটা কচ্ছপের জীবন সাড়ে তিনশ বছর মানুষ কেন এত অল্প সময় বাঁচে। “কোন কোন মৃত্যু হাঁসের পালকের মত তুচ্ছ, আর কোন কোন মৃত্যু পাহাড়ের মত ভারী।” রিয়াজউদ্দিন আহমেদ এর মৃত্যু সাংবাদিক সমাজের কাছে পাহাড়ের মত ভারী দৃশ্যমান হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়।
রিয়াজউদ্দিন আহমেদের কর্ম চিন্তা চেতনা এবং মূল্যবোধের কারণেই দেশের মানুষ দীর্ঘদিন তাকে স্মরণ রাখবে। তার কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। এই যে ক্ষণস্থায়ী জীবন, সে জীবন সার্থক ও যথার্থ হয় তখনই, যখন তার কর্মে সন্তুষ্ট হয় স্বজন, সহকর্মী ও দেশবাসী। রিয়াজউদ্দিন আহমেদও এরকমই একজন মানুষ ছিলেন। সাংবাদিকতা পেশা সকল বিচারেই এক ব্যতিক্রমী পেশা। এই পেশাই দাবি করে সাংবাদিকদের কমিটমেন্ট। যে কমিটমেন্টটা হচ্ছে জনকল্যাণে নিবেদিত থাকার কমিটমেন্ট। কমিটমেন্ট ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আজীবন ভূমিকা রেখে গেছেন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ। মহান আল্লাহতালার কাছে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ-তায়ালা যেন তাঁর সৃষ্টিশীল কাজগুলোর জন্য তাঁকে আমলের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন এবং তাঁকে যেন জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করেন আমি বিদগ্ধ চিত্তে এই দোয়া করছি।
লেখক: লেখক ও গবেষক