কবি দিলওয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, ৫:২২:৪৫ অপরাহ্ন
মো. মোস্তফা মিয়া
কবি দিলওয়ার বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রধান কবি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনের কথা তার কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে বলে তাকে “গণমানুষের কবি” বলা হয়। কবি দিলওয়ার ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা পৈতৃক নিবাস ‘খান মঞ্জিল’-এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ হাসান খান এবং মাতার নাম মোছাম্মৎ রহিমুন্নেসা। ১৯৫২ সালে সিলেটের উত্তরসুরমার রাজা জিসি হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে এম সি কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন দিলওয়ার। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেখানেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে। ১৯৬০ সালে পেশায় সেবিকা আনিসা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয় দিলওয়ারের।
শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাজীবনের শুরু হলেও একপর্যায়ে রাজধানীতে এসে সাংবাদিকতা শুরু করেন কবি। ১৯৬৭ সালে সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে দৈনিক গণকণ্ঠেও সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। উদীচী ও খেলাঘর আসরের সিলেটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।
১৯৭৭ সালের ৭ মার্চ সিলেটে কবি দিলওয়ারকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সংবর্ধনায় পড়া মানপত্রের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়, ‘গণমানুষের কবি’ দিলওয়ারকে সিলেটের মানুষ অভিনন্দন জানাচ্ছে ‘স্বদেশ, স্বজাতি ও বিশ্বমানবের মঙ্গল কামনাকে অঙ্গীকার করে’ তাঁর ‘আবাল্য কাব্যসাধনার’ জন্য। সেই থেকে ‘গণমানুষের কবি’ অভিধাটি তাঁর নামের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়, যদিও তাঁর পাঠকদের কাছে এটি কোনো আবিষ্কারের বিষয় ছিল না। তত দিনে তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ জিজ্ঞাসা (১৯৫৩), ঐকতান (১৯৬৪), পূবাল হাওয়া (১৯৬৬), উদ্ভিন্ন উল্লাস (১৯৬৯) ও বাংলা তোমার আমার তাঁকে ব্যাপক কবিখ্যাতি এনে দিয়েছে। ১৯৭৭ সালে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে সিলেটের সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিকদের একজন এবং প্রিয় কবিদের তালিকার শীর্ষে।
তিনি কবিতা লিখেছেন, ছড়া লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, সংবাদপত্রের কলাম অথবা দু-একটি ছোট গল্পও লিখেছেন। কিন্তু তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য ছিল নিজের ঘরে, তাঁর লেখার টেবিলে বসে লেখায়। সেই অর্থে তিনি ছিলেন ‘মফস্বলের কবি’। তবে মফস্বলকে যদি সীমিত ভূগোল, সীমাবদ্ধ জীবনদৃষ্টি ও সামান্য বিশ্ববোধের ভুল এবং উন্নাসিক মাপে বিচার করা না হয়, তাহলে দিলওয়ারকে কোনো ক্রমেই মফস্বলের কবি বলা যাবে না। তাঁর ভূগোল ছিল দেশ ও বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত, জীবনদৃষ্টি ছিল উদার-মানবিক এবং তাঁর আধুনিকতা ছিল সময়ের বিচার-বিক্ষোভ-ক্লান্তিকে বুঝতে পারার-তাকে প্রকাশ করার এক অদ্ভুত শক্তিতে পূর্ণ। সময়ের নাড়িতে একটা আঙুল রেখে চলতেন তিনি: সে জন্য সময় ভ্রমণ তাঁকে বিপন্ন করত না।
তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- ‘ঐকতান, ‘পূবাল হাওয়া’, ‘উদ্ভিন্ন উল্লাস’, ‘বাংলা তোমার আমার’, ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’, ‘বাংলাদেশ জন্ম না নিলে’, ‘স্বনিষ্ঠ সনেট’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘দিলওয়ারের একুশের কবিতা’, ‘দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘সপৃথিবী রইব সজীব’ ও ‘দুই মেরু, দুই ডানা’,’অনতীত পঙক্তিমালা’। ছড়াগ্রন্থ : ‘দিলওয়ারের শতছড়া’,’ছড়ায় অ আ ক খ’। এছাড়া প্রবন্ধ, গান, ও ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন তিনি।
নিজের অনেক কবিতায় তিনি অতীতে ফিরে গেছেন, অনেক কবিতায় তাকিয়েছেন ভবিষ্যতের দিকে; কিন্তু সময়ের সমস্যাগুলো কীভাবে মেটাতে হয়, তা তিনি জানতেন। নিজের কবিতায় গণমানুষকে এতটা জায়গা তিনি কেন দিয়েছেন? সে প্রশ্নের উত্তরও তাঁর আধুনিকতার বোধেই পাওয়া যাবে। এই কবির আধুনিকতা শহুরে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, জনবিচ্ছিন্নতা অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটকে বিবেচনায় আনেনি, এনেছে সভ্যতার সংকটকে, মানুষের সংগ্রাম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে।
একই সঙ্গে দিলওয়ার ছিলেন শিকড়সন্ধানী একজন মানুষ, যে শিকড়টি লালন করে সংস্কৃতি। আবার প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন একজন প্রেমিকের দৃষ্টি দিয়ে, প্রেমকে দেখেছেন একজন পূর্ণতা-প্রয়াসী মানুষের দৃষ্টিতে। প্রকৃতির বিপন্নতা এবং বিপন্ন মানুষের প্রকৃতি-সন্ধান সমান্তরালভাবে প্রকাশিত তাঁর কবিতায়। দিলওয়ারের একটা করে বই বেরোত আর তাঁর পাঠকমহলে সেগুলো সাড়া জাগাত। কবি দিলওয়ার ১৯৮০ সালে কাব্য চর্চায় বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৮ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।
যে মানুষ বিপ্লব নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে, জনতার প্রতিরোধ নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তাঁর কাছে রোঁয়াওঠা এই কুকুরটিরও গুরুত্ব ছিল। সামান্যে-অসামান্যে, তুচ্ছে-মহতে তিনি অকারণ বিভাজন টানেননি, মূল্য বিচারে নামেননি- এ ছিল তাঁর আধুনিক মননের আরেক দিক।
দিলওয়ার চলে গেছেন ৭৬ বছরের গৌরবসিদ্ধ পথচলা শেষ করে। তাঁর সঙ্গে একবারই একটু সময় নিয়ে কথা হয়েছিল, যে বছর তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। খ্যাতির মোহ তাঁর ছিল না; আড়ালে থেকে নিজের কাজ করাকেই প্রাধান্য দিতেন। সারা জীবন অটল ছিলেন নিজের বিশ্বাসে। ওই দিন তাঁর সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, তিনি বলতেন ‘যে নিজের বিশ্বাস হারায় সে কবি নয়।’তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ১০ অক্টোবর ২০১৩ সালে ভার্থখলার বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি দিলওয়ারের জন্মদিবসে তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ