পরিবহন দুর্ঘটনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২২, ৯:১৪:৫৪ অপরাহ্ন
নতুন বছরের শুরুতে বিগত বছরের বিভিন্ন সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ও মূল্যায়ন হচ্ছে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ১ জানুয়ারী থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সড়ক, রেল ও নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ১৮২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৮৩৮ জন। বরাবরের মতো গত বছরেও সবচেয়ে বেশী সংঘটিত হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। মোট পরিবহন দুর্ঘটনার মধ্যে ৩ হাজার ২৯টিই সংঘটিত হয়েছে সড়কে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৮৯ জন। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯০৭ জন। এছাড়া ৮৯টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ৯১ জন নিহত ও ২৪ জন আহত হয়েছেন। ৬৪টি নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৫৮ জন। আহত হয়েছেন ৮৮ জন।
বছরের শেষে ১৯ দিনে লঞ্চে অগ্নিকান্ডসহ সড়ক ও ট্রেন দুর্ঘটনায় আরো শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে ৪ হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে পরিবহন দুর্ঘটনায় গত বছর। তবে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশী বলে অনেকের অভিমত। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন খাতে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে মনে করেন। তাদের মতে, বাংলাদেশের পরিবহন খাতে অবকাঠামোগত দুর্বলতা প্রকট। পরিবহন শ্রমিকেরা অদক্ষ। পুরো পরিবহন ব্যবস্থা অনিয়ম ও বিশৃংখলায় ভরা। নিয়ন্ত্রক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যথাযথভাবে দায়িত্বপালনে ব্যর্থ। একই সঙ্গে নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকেও দুর্ঘটনা রোধে সময়োপযোগী তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না। ফলে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য থাকলেও দুর্ঘটনা কমার পরিবর্তে প্রতি বছরই বাড়ছে।
এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালানো, জনগণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সক্ষমতার ঘাটতি ও গণ পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি। এ ব্যাপারে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালকের বক্তব্য হচ্ছে, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার উর্ধ্বমুখী হলেও তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়নেও কর্তৃপক্ষের মাঝে তেমন কোন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। দুর্ঘটনা ঘটছে মূলতঃ সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও পরিবহন খাতে শৃংখলা ফেরানোর লক্ষ্যে ২০১৯ সালে গঠিত একটি কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিলো। এসব সুপারিশ ও বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বলা বাহুল্য, এদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। দিন দিন পরিস্থিতির শুধু অবনতিই ঘটছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনা এমন মারাত্মক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, অনেকে এটাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করা দরকার বলে মনে করেন। জাতীয় সমস্যা বা দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই সমস্যার সুরাহা এখন সময়ের দাবি।
আমরা মনে করি, সড়কে নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা দুরীকরণ এবং একটি সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে সড়কে প্রাণহানির এই হিড়িক হ্রাস পেতে পারে। দেশের অন্যান্য শহর ও নগরগুলোর মতো সিলেটেও এখন মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণ যুবাদের একটি বড়ো অংশ এখন মোটর সাইকেলের চালক। তাদের বেপোরোয়া গতি ও চালানো অন্যান্য যানবাহন ও পথচারীদের জন্য আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষভাবে বৃদ্ধ পথচারীদের প্রায়ই দ্রুতগামী ও বেপরোয়া মোটর সাইকেলের ধাক্কায় হতাহত হতে দেখা যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য অনেক শহর ও নগরীর চেয়ে সিলেট নগরীতে মোটর সাইকেলের সংখ্যা বেশী। সিলেট প্রবাসী বহুল অঞ্চল হওয়ায় প্রবাসীদের দেশীয় স্বজন ও নিকটাত্মীয়রা আর্থিক সচ্ছলতার বদৌলতে সহজেই মোটর সাইকেল ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষম। তাই সিলেটে মোটর সাইকেলের সংখ্যা বেশী। আর তাই এখানে লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ ও বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালকের সংখ্যাও প্রচুর। লাইসেন্স, কাগজপত্র ও দক্ষতা-প্রশিক্ষণ ছাড়াই চলছে অধিকাংশ মোটর সাইকেল। ট্রাফিক বিভাগের অসৎ কর্মকর্তাদের বখরা-বখশিশের বিনিময়ে এগুলো গোটা শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর প্রায়ই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিজেরা যেমন প্রাণ হারাচ্ছে, তেমনি অন্যদেরও হতাহতের কারণ হচ্ছে। আমরা পরিবহন খাতে বিশেষভাবে সড়কের এই নৈরাজ্য অনিয়ম ও বিশৃংখলা দূরীকরণে সরকারের উর্ধ্বতন মহলের আশু পদক্ষেপ কামনা করি।