উত্তাল শাবিতে আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ১:০০:১৭ অপরাহ্ন
শিক্ষার্থীদের পরনে কাফন, সামনে প্রতীকী লাশ
এবার গণঅনশনের ঘোষণা শিক্ষার্থীদের
৬ দিনেও চিঠি পায়নি ভিসির তদন্ত কমিটি
শিক্ষামন্ত্রীর সাথে আলোচনায় শিক্ষক প্রতিনিধি দল
স্টাফ রিপোর্টার :
শিক্ষামন্ত্রীর আলোচনার আহবান, আ’লীগ নেতাদের সমঝোতার উদ্যোগ কোন কিছুই আন্দোলন থেকে সরাতে পারছেনা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। ভিসি পদত্যাগের এক দফা এক দাবী নিয়ে কালও মিছিল-শ্লোগানে উত্তাল ছিলো ক্যাম্পাস। এর পাশাপাশি চলছে আমরণ অনশন। এরমাঝে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে প্রতীকী লাশ সামনে রেখে কাফনের কাপড় পড়ে মৌন মিছিল। এ অবস্থায় অশান্ত শাবিতে কখন বইবে শান্তির সুবাতাস- তা বলতে পারছেন না কেউই।
শিক্ষার্থীদের পরনে কাফন, সামনে প্রতীকী লাশ : শাবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শনিবার কাফনের কাপড় পরিধান করে মৌন মিছিল করেছে। প্রতীকী লাশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এই মৌন মিছিল করে। অনশন কর্মসূচির চতুর্থ দিনে বেলা ৩টা ২০ মিনিটে এক দফা দাবি আদায় করতে কাফনের কাপড় পরে মৌন মিছিল করে তাঁরা।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে দুপুর ২টা ৫০ মিনিটের দিকে অবস্থান নিতে থাকে। এরপরে শিক্ষার্থীরা কাফনের কাপড় পরে সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকে। এসময় একজন শিক্ষার্থী প্রতীকী লাশ হয়ে সামনে শুয়ে থাকে। তার পাশে কোনো এক বোনকে ভাইয়ের লাশের পাশে বসে থাকতে দেখা যায়।
এসময় একজন শিক্ষার্থী বলেন, উপাচার্যের দাবিতে আমাদের ২৩ জন শিক্ষার্থী এখন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা ৭৭ ঘণ্টা ধরে অনশন করছে। অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন। কিন্তু এখনো তারা অনশন ভাঙ্গেনি। বরং তাদের অবস্থানে তারা অনড়। এখন হয়তো আমরা প্রতীকী অবস্থান নিয়েছি, কিন্তু এভাবে চললে হয়তো আমাদের কাউকে সত্যি সত্যি কাফনের কাপড় পরতে হবে।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘আমরা এই মৌন মিছিলের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে চাই যে, তারা ২৪ জন একা নয়। আমরাও মরতে রাজি আছি।’
মৌন মিছিলে লাশ কাঁধে নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বর হয়ে চেতনা একাত্তর প্রদক্ষিণ করে আবারও গোল চত্বরে অবস্থান নেয়। প্রতীকী মিছিলে সকল শিক্ষার্থীকে মুখে মাস্ক পরিধান করতে দেখা যায়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, শনিবার রাত ৮টা পর্যন্ত আমরণ অনশনের ৭৭ ঘণ্টা পার হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দাবির ব্যাপারে কোনো আশার বাণী শোনা যাচ্ছে না। অনশনকারীদের কেউ মারা গেলে হাজারো শিক্ষার্থী উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে করা এই অনশনে অংশ নেবেন। প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে যোগ দেবেন।
গণঅনশনের ঘোষণা শিক্ষার্থীদের : উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এবার গণঅনশনে যাচ্ছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে শিক্ষার্থীদের পক্ষে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ইয়াসের সরকার।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আমাদের ২৩ জন শিক্ষার্থী অনশনের ৭৫ ঘণ্টা অতিবাহিত করলেও ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এখনো পদত্যাগ না করে স্বপদে বহাল থেকেছেন। তাই আমরা সব শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভিসির পদত্যাগের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত গণঅনশন চালিয়ে যাবো।
অনশনরত ১৬ শিক্ষার্থী অসুস্থ : আমরণ অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন সবাই। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে অনশনরত ২৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৬ জন অসুস্থ হয়ে সিলেটের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে ৯ জন মেয়ে ও ৭ জন ছেলে। ১৬ জনের মধ্যে ১৩ জন এম এ জি ওসমানী মেডিকেল, ২ জন মাউন্ট এডোরা ও ১ জন রাগিব বারেয়াতে ভর্তি। তাদের মাঝে ৩ শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
শনিবার দুপুরে অনশনস্থলে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, অসুস্থ ১৭ শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে পরে আবারো অনশনস্থলে ফিরেছেন। অসুস্থদের মধ্যে ৯ জন ছাত্রী।
তিনি আরও জানান, অনশনের প্রায় তিন দিন পেরিয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের গ্লুকোজ লেবেল কমে গেছে। এ জন্য স্যালাইন ও প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।
তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের প্রোটিন লেবেলও কমতে শুরু করেছে। একজন মানুষের প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রোটিন ও ফ্যাটের প্রয়োজন হয়। অনশনরত শিক্ষার্থীদের এগুলোর ঘাটতি হচ্ছে। শিগগিরই শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিন শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান তিনি।
৬ দিনেও চিঠি পাননি ভিসির তদন্ত কমিটির প্রধান : শাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় গত সোমবার একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছিলেন উপাচার্য। তবে ৬ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও শনিবার সকাল পর্যন্ত এই তদন্ত কমিটি কোনো কার্যক্রম শুরু করেনি। এমনকি এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে আনুষ্ঠাানিক কোনো চিঠি পাননি বলেও জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির প্রধান গণিত বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক রাশেদ তালুকদার। তিনি জানান, ‘একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি এখনও পাইনি। ফলে কমিটির কার্যক্রমও শুরু হয়নি।’
তবে রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। প্রশাসনিক ভবনেও তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। এ কারণে তদন্ত কমিটির সদস্যদের এখনও আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া সম্ভব হয়নি। প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হলেই চিঠি প্রেরণ করা হবে।’
শিক্ষার্থীরা না গেলেও শিক্ষক প্রতিনিধি দল ঢাকায় : উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী ফোনে কথা বলে শিক্ষার্থীদের ঢাকায় যাওয়ার আহবান জানান। কিন্তু আহবান প্রথমে মেনে নিলেও পরে তারা ইউটার্ন নেয়। এতে আরো জটিল রূপ নেয় আন্দোলনের। তবে শিক্ষার্থীদের অনড় অটল অবস্থানের মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় গেছেন। প্রতিনিধিদলের মধ্যে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুহিবুল আলম, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. রাশেদ তালুকদার, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস অনুষদের ডিন আরিফুল ইসলাম ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন খায়রুল ইসলাম। শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় শিক্ষামন্ত্রীর বাসভবনে এ বৈঠক শুরু হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের গণমাধ্যমকে বৈঠক শুরুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর সাথে তাদের বৈঠক চলছিলো।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৩ জানুয়ারি। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ’ ছাত্রী। ১৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ ছাত্রীদের আন্দোলনে হামলা চালায়। পরের দিন বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে পুলিশ। ওই দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ওই হামলার প্রতিবাদে ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন নাগরিক ও রাজনৈতিক সংগঠন।