কই মাছের ‘প্রাণ’ আর ভিসিদের ‘মান’
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জানুয়ারি ২০২২, ৯:১০:১৪ অপরাহ্ন
মেসবাহ শিমুল
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদ থেকে রাজপথে। আলোচনা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে, ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ পরিসরে। অবশ্য যতটা না আলোচনা তার চেয়ে শতগুণ বেশি সমালোচনা। নিজ ক্যাম্পাসে এক প্রকার অস্পৃশ্য, অপয়া, অবান্তর হিসেবে লজ্জাজনক দিন পার করছেন তিনি। তিনি তার বাসভবনে বন্দী হয়ে আছেন। তোষামোদকারীরা পাশে নেই। তার জন্য কারো মনে ঘৃণার কমতি নেই। এতোসব নেই’র মাঝে কেবল তিনিই এখন পর্যন্ত স্বপদে বহাল রয়েছেন। তার এই স্বপদে বহাল থাকা নিয়ে আমাদেরও বিস্ময়ের শেষ নেই। আফসোস আর অনুশোচনা আছে তবে, তার জন্য করুা কিংবা মায়া দেখানোর সুুযোগটুকুও নেই। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তিনি যে রেকর্ড গড়েছেন, সেই রেকর্ডই বলে দেয় যে ভিসি হিসেবে ক্যাম্পাসে এক মুহূর্তও তার থাকার অধিকার নেই।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই ক্যাম্পাসের ছাত্র ছিলাম আমি। আমাদের ক্লাস শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসে একটি ভিসি বিরোধী আন্দোলন হয়েছিলো। তখনকার ভিসি ছিলেন অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ। সে সময়ও শিক্ষার্থীরা তার বাসভবন (এখন যেখানে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বন্দি রয়েছেন) ঘেরাও করে রেখেছিলো। আন্দোলনে উত্তাল ছিলো পুরো সিলেট। ক্যাম্পাসের অলিগলি সে সময় ভালো করে চিনতাম না। কিন্তু ভিসির বাস ভবনটা খুব ভালো করেই চিনতাম। প্রতিদিন নিয়ম করে আন্দোলনের মাঠে থাকতাম। তারপর একদিন তার পতন হলো। বাসভবন ভাংচুর হলো। আগুন জ্বালানো হলো বাসভবনের বিভিন্ন স্থানে। আমার চোখে ভিসি ভবনের আগুনের সেই দৃশ্য, সাদা রঙের দেয়ালে কালো ধোঁয়ার দাগ, দরজা-জানালাসহ অসংখ্য স্থানের ভাঙাচোরা দৃশ্য ভাসে। আমি চোখ না বুজলেও যেন স্পষ্ট দেখতে পাই আগুনের লেলিহান শিখার সামনে বন্ধু হিমেল ও জহিরের সেই উড়ন্ত ছবিগুলো। যেই ছবি দেশের প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিলো।
ভিসি মোসলেহ উদ্দীন স্যারের পতন ঘটেছিলো পুলিশের গুলিতে এক ছাত্রের মৃত্যুও পর। মূলত মৃত্যুর ওই খবরটি ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ার পরই মূলত তার বিদায় ঘণ্টা বাজে। তিনি একপ্রকার পালাতে বাধ্য হন ক্যাম্পাস থেকে।
বর্তমান ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ একজন উচ্চালিভাসী প্রশাসক। তার সময়ে ক্যাম্পাসে অনেক দৃশ্যমান উন্নতি সাধিত হয়েছে। সুরম্য অট্টালিকায় শাবি পেয়েছে পূর্ণাঙ্গ রূপ। শুনেছি তিনি ১২শ কোটি টাকার বিদেশি প্রকল্প নিয়েও কাজ করছেন বেশ জোরেশোরে। তাইতো ক্যাম্পাসের অনেক শিক্ষকই তাকে চান। তিনি চলে গেলে এই প্রকল্পগুলোর কী হবে- এই ভেবে ভেবে অস্থিও সময় কাটছে সেইসব শিক্ষকেরও।
শিক্ষার্থীদের আজকের এই সর্বাত্মক আন্দোলনের পেছনের পটভূমি কি সেটি নিশ্চয়ই সবার জানা। তাই সেদিকে না গিয়ে সরাসরি শিরোনামের দিকে চলে যাচ্ছি। বাংলা অভিধানের একটি বহুল প্রচলিত বাগধারা ‘কই মাছের প্রাণ’। যার সঙ্গে আমাদের সবার পরিচিতি রয়েছে। কই মাছ পানি ছাড়া দীর্ঘক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে সে কারণেই এই বাগধারার আবিষ্কার। এমনকী আমরা নিত্যদিন নানা সময়ই এই বাগধারাটির ব্যবহারও করে থাকি।
ভিসি ফরিদ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলন করছেন। তাদের সেই আন্দোলনে একাত্ম হয়ে সাবেক অনেক শিক্ষার্থীই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালসহ দেশের প্রায় সবগুলো ক্যাম্পাসে। অনেকে আবার ক্যাম্পাসের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সিলেটে ছুটে গিয়েছেন। তার পদত্যাগের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে সেখানকার শিক্ষক সমিতিও। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ন্যয্য স্বীকৃতি দিয়ে ভিসি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে পদত্যাগের আহবান জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদের আলোচনায় সংসদ সদস্যরা তার আত্মমর্যাদা বোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একজন উপাচার্য কি করে তার মান-সম্মানের গোষ্ঠী বিনাশ করতে পারেন তা নিয়ে তারা রীতিমত হতবাক হয়েছেন।
তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এইসব আহ্বান, বিক্ষোভ কিংবা সংহতি কোনো কাজে আসছে না। তিনি তার পদ টিকিয়ে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাইরে তার বিরুদ্ধে গণঅনশন চলছে। হাসপাতালের বিছানায় নিস্তেজ কতগুলো প্রাণ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। হাজারো মানুষ ছি: ছি: করছে। তবুও তিনি অপেক্ষায় আছেন ‘পৃথিবী আবার শান্ত হবে, পশ্চাদদেশে আবারো ফিরবে গদি/ আন্দোলন থেমে যায় যদি, এই কষ্ট-গ্লানি নাহি রবে’-টাইপের মনো বাসনা নিয়ে।
দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় এ ধরণের আন্দোলন হয়ে থাকে। বিগত দুই বছর করোনা আমাদের দমিয়ে রেখেছে। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিবেশ প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। কিন্তু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সেই পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ভিসির এমন নির্লজ্জ আকড়ে থাকার রেকর্ড থেকে মনে হচ্ছে তিনি অতীতের সব রেকর্ড মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। তার কাছে জাহাঙ্গীনগর, চট্টগ্রাম বরিশাল, রংপুরের বেগম রোকেয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নিকট অতীতের সকল ভিসি বিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। সেখানকার ভিসিদের চাইতে তার মান মর্যাদার ভীত এতো শক্ত যে দুই সপ্তাহের টানা আন্দোলন, জাতীয় সংসদ থেকে চায়ের দোকানে হওয়া যাবতীয় ভৎসনা-তিরস্কারেও তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি হচ্ছে না। তিনি ইতোপূর্বে আন্দোলনের মুখে পতন হওয়া সকল উপচার্যদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কি করে শত বঞ্চনার মধ্যেও নিজের গদি ঠিক রাখা যায়। তিনি সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কি করে হাজারো গালি হজম করেও নিজের ‘মান’ ঠিক রাখা যায়। সম্ভবত তিনি তার পূর্বসূরী ভিসি মোসলেহ উদ্দিনকেও টপকে যাবেন। কেননা মোসলেহ উদ্দিনের পতন হয়েছিলো মাত্র একজন ছাত্রের মৃত্যুর পর।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, শাবিপ্রবি।