ইংরেজী সাইনবোর্ডে কালি লেপন!
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৮:০১:২২ অপরাহ্ন
সম্প্রতি মিডিয়ায় ‘চট্টগ্রামে ইংরেজী নামে কালো কালি লাগিয়ে দিচ্ছে চসিক’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারীতে নগরীর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ইংরেজীতে লেখা নাম ফলকে (সাইনবোর্ড) কালো কালি লাগানো শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ভ্রাম্যমাণ আদালত কালো কালি লাগিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। অভিযানকালে ইতোমধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে ইংরেজী নাম ফলকের জন্য ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, অতীতে পাকিস্তান আমলে একুশে ফেব্রুয়ারী এলে বিভিন্ন কলেজ থেকে মিছিল বের হতো। সেসব মিছিল থেকে মিছিলকারীরা দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইংরেজীতে লেখা সাইনবোর্ডগুলো ভাংচুর করতো, ঢিল ছুঁড়তো। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে অনেকে এ ধরণের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর নামে দেশ থেকে ইংরেজী বর্জনের একটি আত্মঘাতী ও অপরিনামদর্শী তৎপরতা শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষা ও অফিস আদালতের বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে ইংরেজী বর্জনের একটি ব্যাপক কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়, এমনকি এক পর্যায়ে এরশাদ শাসনামলে বিএ ক্লাশ থেকে বাধ্যতামূলক ইংরেজী বিষয়কে বাদ দেয়া হয়।
একশ্রেণীর শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক ইংরেজী শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করতে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। এক্ষেত্রে বাংলাভাষার উন্নয়ন, গবেষণা ও সকল স্তরে বাংলা চালুর গঠনমূলক প্রচেষ্টার চেয়ে ইংরেজী ভাষাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে তাদের ওঠে পড়ে লাগতে দেখা যায়। এর ফল হয় ভয়াবহ। এতে দেশে আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজী শেখা ও চর্চার প্রতি জনগণ বিশেষভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে অনীহা ও অবহেলা সৃষ্টি হয়। অথচ এ সময়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকাসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজী শিক্ষা ও অনুশীলন চলছিলো দুর্দান্ত গতিতে। এভাবে সর্বস্তরে বাংলা চালুর ছদ্মাবরণে ইংরেজী বর্জনের আত্মঘাতী তৎপরতার ফলে এদেশের জনগণ বিশেষভাবে শিক্ষার্থীরা ইংরেজী শিক্ষায় পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। গত নব্বইয়ের দশক থেকে বিদেশে অভিবাসন, কর্মসংস্থান ও পড়াশোনার বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হলে এদেশের লোকজন ও শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ইংরেজী না জানার কারণে বিদেশে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এসব ক্ষেত্রে তারা প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। বিদেশে চাকুরী লাভের প্রতিযোগিতায় ঐসব দেশের লোকজনের কাছে হারতে শুরু করে। দেখা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানে যখন কোন, ভারতীয় পাকিস্তানী কিংবা শ্রীলংকায় প্রবাসী ম্যানেজার, ফোরম্যানসহ বিভিন্ন উচ্চপদে অধিক বেতনে যখন কাজ করছে, তখন একজন বাংলাদেশীকে শুধুমাত্র ইংরেজী না জানার কারণে সাধারণ শ্রমিক কর্মী হিসেবে স্বল্প বেতনে কাজ করতে হয়েছে। এ অবস্থা আজো অব্যাহত।
আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজী শিক্ষা ও অনুশীলনের অভাবে শুধু বিদেশে নয়, দেশে চাকুরীসহ বিভিন্ন কাজকর্মে আজো নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে পুরো দু’টি প্রজন্মকে। বর্তমানে অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে যখন ইংরেজী শিক্ষা ও চর্চা আবার শুরু হয়েছে এদেশে, তখন একশ্রেণীর লোক এটাকে বিঘ্নিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও জাতির জন্য অশনি সংকেতস্বরূপ। আবারো সকল স্তরে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার ও চর্চা প্রত্যাশা করি। প্রত্যাশা করি বাংলা ভাষার উন্নয়নে ব্যাপক গবেষণা ও অনুশীলন। কিন্তু তা পেশাগত ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের প্রযুক্তি হিসেবে গণ্য এবং জ্ঞান বিজ্ঞান ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা অর্থাৎ সার্বজনীন বা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বিবেচিত ইংরেজীকে পরিত্যাগ, বর্জন বা অবহেলা করে নয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ইংরেজী সাইনবোর্ড নিষিদ্ধ না করে এবং সাইনবোর্ডে কালি না লাগিয়ে ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা নামফলক বা সাইনবোর্ড ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা জারি করতে পারেন। কারণ গ্লোবাল ভিলেজ হিসেবে বিশ্বের সকল দেশ ও অঞ্চলই এখন বিশ্ববাসীর কাছে অবারিত, আঞ্চলিকতার ধারণা এখন ক্ষয়িষ্ণু। একজন বিদেশী অর্থাৎ ভিন্নভাষী বাংলা না জানার কারণে যাতে এদেশের কোন ব্যবসা বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে অসুবিধায় না পড়ে সেকথা বিবেচনা করে এদেশের যে কোন দোকানপাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজী সাইনবোর্ড বা নামফলক ব্যবহার উচিত বলে আমরা মনে করি। আশা করি সংশ্লিষ্ট সকলে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন ।