ওষুধ নিয়ে নৈরাজ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২২, ২:০২:১৯ অপরাহ্ন
জীবন রক্ষাকারী ওষুধ খেয়ে যখন কোন মানুষ সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে মারা যায়, তখন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ তো বটে, সাধারণ মানুষের মাঝেও চরম উদ্বেগ ও শংকা সৃষ্টি হয়। এ ধরণের উদ্বেগ ও আতংক হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্বরাক্রান্ত দুই শিশু নাপা সিরাপ পানের পর মারা যাওয়ায় একটি ওষুধ কোম্পানীর এই প্যারাসিটামল সিরাপের নমুনা পরীক্ষা করে ক্ষতিকর কিছু না পাওয়ার কথা জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
মৃত্যুর ঘটনাটি জানার পরদিন সারা দেশের পাইকারি ও খুচরো দোকান পরিদর্শন করে নাপা সিরাপের একটি ব্যাচের ওষুধ পরীক্ষা করার নির্দেশ দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর ৩ দিন পর সোমবার বিকেলে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি জানান, আশুগঞ্জের যে দোকান থেকে কেনা ওষুধ সেবনের পর শিশু দুটি মারা গেছে, সেই দোকান থেকে ৮টি বোতল জব্দ করেন তারা। এছাড়া ডিপো থেকে আরও দু’টি ব্যাচের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তবে তিনি জানান, যে বোতলের সিরাপ শিশু দু’টিকে খাওয়ানো হয়েছিলো, সেটা পরীক্ষা করতে পারেনি এই অধিদপ্তর। রোববার এসব নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়, এর ফল পাওয়া যায় সোমবার দুপুরের পর। কয়েক ঘণ্টা পর অর্থাৎ ঐদিন বিকেলেই আয়োজন করা হয় এই সংবাদ সম্মেলনের। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ড্রাগ টেস্টিংয়ে প্রপাইলিন গ্লাইকল আছে আর ক্ষতিকারক উপাদান ডাইইথিলিন গ্লাইকল পাওয়া যায়নি। উপরোক্ত ঘটনাটি যে কোন মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন ও বিস্ময়ের জন্ম দিতে পারে।
যে দেশে কোন দুর্ঘটনা বা অপঘাতে এক ডজন লোক মারা গেলেও সেই ঘটনা বা দুর্ঘটনা তদন্তে দীর্ঘদিন লেগে যায়, সেক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সেবনের পর মৃত্যুবরণকারী ২ জন মানুষের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটন না করেই অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ওষুধের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে। বিষয়টি জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
অনেকের প্রশ্ন, ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক জানিয়েছেন নাপা সিরাপ পরীক্ষায় একটি বিশেষ ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়নি। তিনি অন্য কোন ক্ষতিকর উপাদান এতে আছে কি-না, তা স্পষ্ট করেননি। এছাড়া তিন দিনের মধ্যে গোটা দেশে ছড়িয়ে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের ভালোমন্দ কীভাবে পরীক্ষায় সমর্থ হলো ঔষধ প্রশাসন, এটাও এক বিস্ময়। সর্বোপরি, যে বোতলগুলোর ওষুধ খেয়ে শিশু দু’টি প্রাণ হারালো, সেই বোতলের ওষুধ কিংবা বোতলটিও কেনো পরীক্ষা করা হলো না কিংবা শিশুরা কী কারণে বা কোন জিনিসের বিষক্রিয়া কিংবা বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় মারা গেলো, তা-ও পরীক্ষা করে উদঘাটন বা প্রকাশ করা হয়নি। সব মিলিয়ে এক সন্দেহ ও রহস্যের ধোয়াশা সৃষ্টি হয়েছে এই শিশু মৃত্যুর ঘটনায়।
একথা সত্য যে, বাংলাদেশে ওষুধ নিয়ে নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ওষুধের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি ছাড়াও নকল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। ইতোপূর্বে ঢাকার বিভিন্ন ওষুধ পাড়ায় বিশেষভাবে মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করতে দেখা যেতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। এসব অভিযানে প্রচুর নকল, নিম্নমানের ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ করা হতো। সাম্প্রতিক সময়ে এমনটি করতে দেখা যাচ্ছে না। এর অর্থ এই নয় যে, দেশের মার্কেটে এ ধরণের নিষিদ্ধ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে না। অনেকের অভিযোগ, ওষুধ প্রশাসনের অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশে নকল ওষুধের কোম্পানী ও ব্যবসায়ীরা চুটিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। গত দেড়/দু’বছরের করোনা মহামারি এদেশের ওষুধ প্রশাসনসহ গোটা চিকিৎসা খাতকে তছনছ করে দিয়েছে। ওষুধের বাজার এখন নিয়ন্ত্রণহীন, অনেকটা নিত্যপণ্যের বাজারের মতোই। ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় তালিকাবহির্ভুত ওষুধের দাম উৎপাদক প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করবে।
সেই নির্দেশনার বলে ইচ্ছামতো দাম বৃদ্ধি করে চলেছে ওষুধ কোম্পানীগুলো। ফলে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের দুর্নীতি ও গাফিলতির কারণে দেশ এখন নকল ও নিম্নমানের ক্ষতিকর বিভিন্ন ওষুধের লাভজনক মার্কেটে পরিণত হয়েছে। অনেক নামদামী কোম্পানীর ওষুধ ও তেমন কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই বাজারজাত করণের অভিযোগ রয়েছে। এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও তেমন কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণা করতে দেখা যাচ্ছে না কর্তৃপক্ষকে। এ ধরণের কোন নিম্নমানের নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিংবা ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বর্ণিত শিশু দু’টি মারা যেতে পারে, এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু যদি ঘটে থাকে, তা উদঘাটন করবে কে? প্রভাবশালী ওষুধ কোম্পানীগুলোর ততোধিক প্রভাবশালী মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কে?