সিলেটে হঠাৎ বেকারী পণ্যে আগুন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০২২, ২:০০:০৫ অপরাহ্ন
নেই মনিটরিং, ইচ্ছেমতো মূল্য নির্ধারণ
এমজেএইচ জামিল : ভোজ্যতেল সহ নিত্যপণ্যের প্রভাব পড়েছে বেড়েছে বেকারি পণ্যের উপর। সিলেটের বেকারী পণ্যে হঠাৎ যেন আগুন দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ টাকার ব্রেড এখন ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্রেড, বিস্কুট, কেক সহ সকল প্রকার কনফেকশনারি পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। এজন্য ভোজ্যতেল সহ নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির উপর দায় চাপাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
মঙ্গলবার নগরীর বিভিন্ন কনফেকশনারী দোকানে গিয়ে দেখা যায়, ১০ টাকা মূল্যের ব্রেড বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা, ২০ টাকার ব্রেড ২৫/৩০ টাকা, ৩০ টাকার ব্রেড ৫০ টাকা। ৫০ টাকার ব্রেড ৬০/৫৬ টাকা, ৬০ টাকার ব্রেড ৮০ টাকা। তবে কোম্পানীর নামভেদে ব্রেডের দামেরও ভিন্নতা রয়েছে।
এদিকে সিলেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরীর সঠিক তথ্য কোন সরকারী দফতরে নেই। বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার, বিসিক কেউই জানেনা তাদের পণ্যের দাম নির্ধারণ সম্পর্কে। বিভিন্ন কারখানা ও ফ্যাক্টরীর মালিকরা নিজেরা বসে একটা মূল্য নির্ধারণ করে দেন। সেই অনুযায়ী বিক্রি হয় ব্রেড ও বিস্কুট জাতীয় পণ্য। মূল্য তালিকা কোন সরকারী দফতরে দিতে হয়না জমা। ফলে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গেল বছরের ২০ ফেব্রুয়ারী থেকে বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারী প্রস্তুতকারক সমিতি সিলেট জেলার এক সভায় বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতি ও বেকারী উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেকারীর সব ধরনের পণ্যে শতকরা ২০ ভাগ দাম বৃদ্ধি করা হয়। বেকারীর প্রতিটি পণ্য তেল, ময়দা, চিনির দাম অধিক হওয়ায় তখন বেকারীর প্রতিটি পণ্যে শতকরা ২০ ভাগ দাম বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু চলতি মাসে ভোজ্যতেল সহ নিত্যপণ্যের আরেকদফা দাম বাড়ায় ফের বাড়ানো হয়েছে বেকারী পণ্যের দাম। তবে এবার অনেকটা মনগড়া, ইচ্ছেমতো মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। দাম বাড়ানোর সাথে অনেক পণ্যের পরিমাণও কমানো হয়েছে। আবার কিছু পণ্যের দাম বাড়ানো হলেও পণ্যের পরিমাণ ঠিক আছে।
নগরীর কয়েকটি ব্রেড বিস্কুটের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, সিলেটের বাজারে বর্তমানে দুই ধরনের বেকারী পণ্য রয়েছে। অভিজাত মিষ্টান্ন কোম্পানীগুলোর ব্রেডের দাম খুব একটা না বাড়লেও তাদের বিস্কুটের দাম বেড়েছে বেশী। আবার সিলেটের স্থানীয় বেকারী পণ্যের বিস্কুটের দাম সামান্য বাড়লেও ব্রেডের পরিমাণ কমিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। সিলেটের অভিজাত মিষ্টান্ন কোম্পানীগুলোর মধ্যে বনফুল, মধুবন, স্বাদ, ফিজা, ফুলকলি, পিউরিয়া, মি: সুইট, মধুফুল সহ কয়েকটি কোম্পানীর ব্রেডের দাম বাড়লেও পণ্যের পরিমাণে খুব একটা হেরফের হয়নি। তবে স্থানীয় বেকারীগুলোর মধ্যে মৌমিতা, সানবেস্ট, মধুমিতা, বসুন্ধরা, রিশতা সহ বিভিন্ন কোম্পানীর ব্রেডের দাম বাড়ানো হলেও কমিয়ে দেয়া হয়েছে পণ্যের পরিমাণ। তবে তাদের বিস্কুটের দাম খুব একটা বাড়ানো হয়নি।
এ ব্যাপারে স্বাদ কোং এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আলম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, করোনা মহামারী ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ফের সকল নিত্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে কনফেকশনারি পণ্যের দাম বেড়েছে অত্যাধিক। বাধ্য হয়েই আমাদেরকে দাম বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানীর ব্রেড ও বিস্কুটের দামের পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ সব কোম্পানী বা বেকারী এক ধরনের আটা ময়দা ব্যবহার করেনা।
বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারী প্রস্তুতকারক সমিতি সিলেট জেলা সভাপতি ছালেহ আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সকল নিত্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। গেল বছর আমরা সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে বেকারী পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেছিলাম। কিন্তু আনুষ্ঠানিক সভা না করেও একটা নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী পণ্যের দাম বেড়েছে। ব্রেডের দাম বাড়ানোর পরও কিছু কোন বেকারী পণ্য পরিমানে কমিয়ে থাকলে সেটা অনৈতিক।
তিনি বলেন, আমাদের সমিতির আওতায় সিলেটে ৫৭টি বেকারী রয়েছে। এসব বেকারীতে ব্রেড, বিস্কুটের পাশাপাশি কেকসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। সিলেটের বাজারে স্থানীয় বেকারীর ব্রেড বেশী চলে। তাই স্থানীয়রা ব্রেডের দাম বাড়িয়েছে। তবে স্থানীয় বেকারী সমূহের বিস্কুটের দাম কিন্তু খুব একটা বাড়ছেনা। এক্ষেত্রে অভিজাত কনফেকশনারির সাথে বেকারী গুলোর তুলনা করা যায়না। কারণ বেকারীর বিস্কুটের দাম নির্ধারণ করা হয় ক্রেতার দিক লক্ষ্য রেখে।
বিএসটিআই সিলেটের উপপরিচালক (মেট্রোলজি) মো. লুৎফুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ব্রেড বিস্কুটের দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে গায়ে লেখা ওজন অনুযায়ী পণ্য প্যাকেটে বা কৌটায় থাকতে হবে। এছাড়া পণ্যের মান ঠিক থাকতে হবে। এসবে কোন ভেজাল হলে বিএসটিআই একশনে যেতে পারে।
ভোক্তা অধিকার সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ব্রেড বিস্কুটের পণ্যের দাম নির্ধারণ নিয়ে সিলেটে সরকারীভাবে কোন কর্তৃপক্ষ আছে বলে আমার জানা নেই। যদি কোন ক্রেতা বেকারীজাত পণ্য কিনে প্রতারিত হন। কিংবা কেউ যদি অধিক মুনাফা লাভের চেষ্টা করে তাহলে ভোক্তা অধিকার বেকারীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হবে।
বিসিক সিলেটের উপ মহা ব্যবস্থাপক ম সোহেল হাওলাদার বলেন, বিসিক শিল্পনগরীর ভিতরে যেসব কারখানা বা ফ্যাক্টরী রয়েছে তারা যদি কোন অনিয়ম করে আমরা প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু কোন বেকারী পণ্যের কত দাম নির্ধারণ করবে সে ব্যাপারে আমরা কিছু করতে পারিনা।
বেকারী পণ্যের ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, আগে বাজারে ৫০ কেজির আঁটার বস্তার দাম ছিল ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা কিন্তু এখন আঁটার বাজার মূল্য ৩ হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া তেল, ঘি ও চিনি এ সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বেকারি পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে ব্যবসায়ীরা। তবে সাধারণ মানুষের অভিযোগ, আগে ১০ টাকায় যে রুটির সাইজ ছিল সেই রুটির সাইজ ধীরে ধীরে করে ছোট আকারে বানানো হয়েছে। এ ছাড়া হঠাৎ দাম বৃদ্ধি করায় বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
নগরীর আম্বরখানা এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, আগে ১০ টাকায় যে ব্রেডের সাইজ ছিল সেই ব্রেডের সাইজ এখন ছোট করে বানানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ এত দামে বেকারির পণ্য কিনতে নারাজ। প্রতিদিন যেখানে আমার ৩০ থেকে ৪০ পিস ব্রেড বিক্রি হয় সেখানে দাম বৃদ্ধিতে ২০ পিস ব্রেড বিক্রি হয়েছে। সবকিছুর দাম বাড়ছে এর জন্যই বেকারির পণ্য দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
সুবিদবাজার এলাকার শ্রমজীবি রুহুল ইসলাম বলেন, সামান্য বনরুটির দাম তাও দ্বিগুণ হয়ে গেল বাজারে সবকিছুর দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি প্রতিদিন সকালবেলা একটা চা ও একটা বনরুটি খাই। সম্প্রতি সকালে স্থানীয় চায়ের দোকানে গেলে দোকানদার জানান রুটি কিন্তু এখন ১০ টাকা। দাম শুনে আমি অবাক হয়ে যাই। যে রুটি ৫ টাকায় খেয়েছি সেই রুটি এখন ১০ টাকায় খেতে হবে। আগে ২ টাকায় যে রুটি পাওয়া যেত সেই রুটি এখন ১০ টাকাও পাওয়া যাবে না। আমাদের মত পরিবারগুলো মুখ বুজে আর্তনাদ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
কয়েকজন বেকারী ব্যবসায়ী জানান, দেশে সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে আটা, তেল, ঘি ও চিনি এ সকল পণ্য বেকারীর জন্য খুব জরুরী। তবে এই সকল পণ্যের দাম অনেক আগেই বৃদ্ধি পেয়েছে তারপরেও আমরা দাম বাড়াইনি। বেকারীর কারখানার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হয়েছে। এই সকল দিক বিবেচনা করে বেকারীর পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেকারীর পণ্যের দাম যদি বৃদ্ধি না করা হয় তাহলে আমাদের বেকারী বন্ধ করে দিতে হবে।