১০ বছরে চার প্রকল্পের একটিও দেখেনি আলোর মুখ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০২২, ৩:১০:৩৬ অপরাহ্ন
সুরমা’র খনন নিয়ে পাউবো ও বিআইডব্লিউটিএ’র রশি টানাটানি

এ টি এম তুরাব :
প্রায় দেড় যুগ পর ফের বন্যার কবলে পড়ে সিলেট। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুরমার দুই তীর ছাপিয়ে ডুবিয়ে দেয় নগরী। আর এই দুর্ভোগের জন্য সুরমার নাব্য সঙ্কটকেই দায়ী করছেন সিটি মেয়র। এ অবস্থায় নদী খননে পরিকল্পনার কথা বলছে বিআইডবিøউটিএ। তবে কে কাজ করবে এই নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে চলছে টানাটানি।
এদিকে চলমান বন্যার পর ফের আলোচনায় এসেছে এই অঞ্চলের প্রধান নদী সুরমা খননের বিষয়টি। দীর্ঘদিন নদী খনন না করায় বেশি ভুগতে হচ্ছে নগর ও সুরমা তীরবর্তী মানুষকে। আর এজন্য সুরমার নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে এবার বন্যার পর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সুরমা নদী খনন করা হবে।
সম্প্রতি বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও বলেন, সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি আটকে থাকছে। এই নদী খনন করতে হবে। আগামী বর্ষার আগেই নদী খনন করা হবে উল্লেখ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিলেটের নদীগুলো খননের ব্যাপারে আমাদের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক। আমরা নদী খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী বর্ষার আগেই নদীগুলো খনন করতে হবে। তবে এখনও নদী খনন প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়ায় বর্ষার আগে আদৌ নদী খনন সম্ভব হবে কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
খনন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী জালালাবাদকে বলেন, সুরমা নদী এক দিনে ভরাট হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে পলি জমে এটি এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। আরও আগেই এই নদী খননের উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে নদী খননের প্রকল্পই পাস হয়নি। সরকারি প্রকল্পে যে জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, তাতে প্রকল্প পাস হয়ে কাজ শুরু হতেই বছর পেরিয়ে যায়। ফলে আগামী বর্ষার আগে খননকাজ শেষ হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবু আমরা চাই, দ্রæততম সময়ের মধ্যেই যেন খনন কাজ শুরু হয়।
চার প্রকল্পের ১টিও দেখেনি আলোর মুখ : ১০ বছরে সিলেটের প্রধান নদী সুরমা খননে চারটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রস্তাবনাগুলো (ডিপিপি) পাঠানো হয় মন্ত্রাণলয়ে। এরপর তিনবার সমীক্ষাও চালানো হলেও এখনও কোন প্রকল্পই আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং বিভাগ সুরমা খননে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেটিও এখন পর্যন্ত পাস হয়নি। এরও আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সুরমা খননে তিনটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে সুরমা নদী খননে সর্বপ্রথম একটি প্রকল্প নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পাউবোর সিলেট সিলেট কার্যালয় থেকে এই প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তাবের পর নদী খননে সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার পর নদী খননে উদ্যোগ নেয়ার কথা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানোও হয়েছিলো। এরই মধ্যে দীর্ঘ ৬ বছর চলে গেলেও এ ব্যাপারে আর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এরপর আবার ২০১৭ সালে ৩০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প পাঠায় পাউবো। আর ২০১৯ সালে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ ও নদীর তীর প্রতিরক্ষার জন্য ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি ডিপিপি পাঠায় পাউবো। সেবারও সমীক্ষা চালানো হয়। তবে সমীক্ষায়ই আটকে যায় কার্যক্রম। আবার ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিøউটিএ) সুরমা খননে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ওই বছর চলানো হয় সমীক্ষা। এই প্রকল্পও এখনও মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে।
এদিকে পাউবোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সুরমা ও কুশিয়ারা ভারত থেকে উৎপত্তি হয়েছে। সুরমার প্রথম ২৫ কিলোমিটার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত লাইন দিয়ে গেছে। ফলে উৎসমুখ থেকে খননের জন্য যৌথ নদী কমিশন থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। যৌথ নদী খনন করতে হলে দুই দেশের যৌথ সম্মতি ও চুক্তির প্রয়োজন হয়। ভারতের সঙ্গে চুক্তি না হওয়ায় এতো দিন আটকে ছিল এই নদী খনন। তবে সম্প্রতি যৌথ নদী প্রটেকশনের আওতায় ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ বলেন, নদী খননে আমরা তিনটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকল্পগুলো পাস হয়নি। আর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) ছাইদুর রহমান বলেন, আমরা ৩ হাজারের কিছু বেশি টাকার একটি প্রকল্প জমা দিয়েছিলাম। অনেক দিন আগেই এটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা হয়েছিল। তবে এখনো পাস হয়নি।
খনন নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ-পাউবো’র টানাটানি : সুরমা নদী খনন না করায় ভুগতে হচ্ছে সিলেট নগর ও সুরমাতীরবর্তী মানুষকে। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়রা খননের দাবী জানালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে চলমান বন্যার পর ফের আলোচনায় সুরমা খননের বিষয়টি। এ অবস্থায় নদী খননে পরিকল্পনার কথা বলছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে কে খনন কাজ করবে এ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে চলছে টানাটানি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে পাউবোর সিলেট কার্যালয় থেকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ ও নদীতীর প্রতিরক্ষার জন্য ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি ডিপিপি পাঠানো হয়। এরপর ২০২০ সালে বিআইডব্লিউটিএ সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে সমীক্ষা চালায়।
পাউবোর সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমদ জালালাবাদকে বলেন, সমীক্ষা করার পর বিআইডব্লিউটিএ থেকে আমাদের জানানো হয়, আমাদের ডিপিপি থেকে খননের বিষয়টি বাদ দেয়ার জন্য। এরপর তারা ড্রেজিংয়ের জন্য আলাদা একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে। তারাই সুরমা ও কুশিয়ারা খনন করবে।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে আমরা নদী খননের বিষয়টি বাঁধ দিয়ে ৪ হাজার কোটি টাকার আরেকটি ডিপিপি প্রেরণ করেছি। এটিও এখন সমীক্ষার পর্যায়ে আছে। আমি কিছুদিন আগেও বিআইডবিøউটিএ’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা জানিয়েছেন, তারাই ড্রেজিং করবে।
এ প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ’র ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) ছাইদুর রহমান জালালাবাদকে বলেন, আমরা যেহেতু প্রকল্প জমা দিয়েছি তাহলে আমরাই কাজ করবো। কিন্তু আগের বাজেট এখন পুনর্মূল্যায়ন করা লাগতে পারে।
উৎসমুখ ভরাট : সিলেটের প্রধানতম নদী সুরমার দুই রূপ। বর্ষায় দুকুল উপচে ডুবিয়ে দেয় জনবসতি। আর গ্রীষ্মে পানি শুকিয়ে পরিণত হয় মরা গাঙে। জেগে উঠে চর। প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই নদী বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে পানিহীন, মৃতপ্রায়। পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে নদীর তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভ‚মি। অপরদিকে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য মতে, সুরমার উৎসমুখই ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে এ নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে শতাধিক চর জেগে উঠে। বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, উজান থেকে ঢলের সাথে বালু ও পলি নামে। তাই নিচের দিক খননের চেয়ে উজানে খনন করা বেশি জরুরি। কেবল উৎসমুখই নয়, ঢলের সাথে আসা বালিও পলিতে ভরাট হয়ে গেছে প্রায় পুরো সুরমা নদী। শুষ্ক মৌসুমে জকিগঞ্জ থেকে সিলেট পর্যন্ত নদীতে শতাধিক স্থানে জেগে ওঠে চর। দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, কানাইঘাট, টুকেরবাজারসহ কয়েকটি স্থানে নদীর জেগে ওঠা চরে শুষ্ক মৌসুমে সবজি চাষও করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ সময় প্রায় বন্ধ হয়ে যায় নৌ-যান চলাচল। প্রায় পুরো নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালে সুনামগঞ্জের কিছু অংশ খনন করা হলেও তাতে কোন সুফল পাওয়া যায়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, সুরমাসহ এই এলাকার বেশির ভাগ নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। এগুলো খনন করা প্রয়োজন। নদী খননের জন্য গত বছর আমরা ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সম্ভাব্যতা যাছাই শেষে এটি এখন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন।
তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠানই খননের দায়িত্ব পাক, আগামী অর্থবছরেই খনন হতে পারে সুরমা। ইতোমধ্যে বিআইডব্লিউটিএ খালাইঘাট থেকে ছাতক পর্যন্ত সুরমা নদী খননের ডিজাইন করেছে। তবে কাজটি করা হয়নি। খনন কাজ হয়ে গেলে বন্যার প্রকোপ কমতো বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।