শিক্ষা উপকরণের দামও লাগামহীন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুন ২০২২, ৪:০৫:৫৯ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল :
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে শিক্ষা উপকরণেও। হঠাৎ করেই বই, খাতা, কলমসহ দাম বেড়েছে স্টেশনারী সামগ্রীর। প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ভর্তুকি থাকার পরও শিক্ষা উপকরণের এমন লাগামহীণ মূল্যবৃদ্ধিতে শঙ্কিত অভিভাবকমহল। কাগজ, কলম ও বই গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি জিনিসের দাম ভর্তুকি দিয়ে হলেও কমানোর দাবী সচেতন মহলের। সারাদেশের ন্যয় সিলেটেও উর্ধ্বমূখী সবধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গেল ১ বছর ধরে বই ও খাতার মূল উপকরণ কাগজসহ সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। আর ফটোকপি করা বইয়ের দাম বেড়েছে গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। সমাজের উচ্চবিত্তের মাঝে প্রভাব প্রকট না হলেও শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের মধ্যে পড়েছে।
নগরীর কয়েকটি শিক্ষা উপকরণের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের তৈরি খাতার দাম বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। সেই সঙ্গে বেড়েছে বইয়ের দামও। প্রয়োজনের তাগিদে কিছু না কিনে ফটোকপি করে চলা যায়। কিন্তু ফটোকপি বইয়ের দাম বেড়েছে গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এদিকে কিছুক্ষেত্রে বইয়ের দাম না বাড়ালেও গাইডে ব্যবহৃত হচ্ছে নিম্নমানের কাগজ। আগামীতে বই আসলে সকল বই খাতার দাম আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া দেশের বইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে পাঞ্জেরী ও লেকচার। ২য় শ্রেণী থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল মাদরাসায় গাইডের ব্যবসা করছে এই দুই কোম্পানী। ফলে বাজারে অন্য কোন কোম্পানীর বই নেই। তাই বাধ্য হয়ে তাদের নির্ধারণ করা দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে বই। নির্ধারিত দাম থেকে নামমাত্র কমিশনে বই বিক্রি করে লাভবান হতে পারছেন না লাইব্রেরী ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে কমিশনের জন্য লাইব্রেরী মালিকদের সাথে বাক বিতন্ডা করতে দেখা গেছে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের।
মঙ্গলবার নগরীর বিভিন্ন লাইব্রেরী ও স্টেশনারী দোকান ঘুরে দেখা গেছে, স্টেশনারী ও শিক্ষা উপকরণ বিক্রির দোকানগুলোতে ৪০ টাকার ব্যবহারিক খাতা এখন ৫০ টাকা, ৬০ টাকার খাতা ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৩০০ পৃষ্ঠার খাতা ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা, ১২০ পৃষ্ঠার খাতা ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা, কালার পেপার রিম ৩২০ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রেজিস্টার খাতা ৩০০ পৃষ্ঠা ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা, ৫০০ পৃষ্ঠা ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
মিনি ফাইল প্রতিটি ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা। জিপার ফাইল ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। কলমের দাম ডজনপ্রতি বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। মার্কার পেন প্রতি পিস ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে। সাধারণ ক্যালকুলেটর ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা, ৯৯১ এক্স ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭০০ টাকা, ৯৯১ এক্স প্লাস ১ হাজার ৩৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা, ৯৯১ এমএস ৮৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জ্যামিতি বক্স ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ১০০ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্লাস্টিক ও স্টিলের স্কেল ডজনপ্রতি ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। রাবার ডজনপ্রতি ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা বেড়েছে।
আম্বরখানা এলাকার ফটোকপির দোকানী শামীম আহমদ বলেন, কালি ও কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফটোকপির দাম বেড়েছে। আগে প্রতি কপি ফটোকপি করতে এক টাকা নিতাম। তা এখন দেড় টাকা থেকে দুই টাকা নিতে হচ্ছে।
মদীনা মার্কেট এলাকায় একটি ফটোকপির দোকানে কথা হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রবিন আহমদ ও সুজনের সঙ্গে। তারা জানান, পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন বই ও নোট ফটোকপি করতে হয়। কিন্তু এখন ফটোকপির ব্যয়ও বেড়েছে। এ নিয়ে আমরা পড়ছি বিপাকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কালে আলাপকালে তারা জানান, কাগজ ছাড়াও পুস্তক প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব উপকরণের দাম বেড়েছে। প্লেটের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া লেমিনেশনের দর দ্বিগুণ, সব ধরনের কেমিক্যালের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এজন্য বইয়ের দাম বেড়েছে। যে প্রকাশনীর বই বাজারে একবার শেষ হচ্ছে, সেই বইয়ে দাম বেড়ে বের হচ্ছে। দেড় মাস আগে প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। এখন তা ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে সময়ে সাদা কাগজের মূল্য ছিল প্রতি টন ৭০ থেকে ৭১ হাজার টাকা। এখন তা ৯৬ হাজার টাকার ওপরে কিনতে হচ্ছে। এই দামের প্রভাব বই এবং খাতার ওপরে পড়ছে।
সিলেট মডেল লাইব্রেরীর স্বত্বাধিকারী রোটারিয়ান মিজানুর রহমান জানান, বিগত ১ বছরে কয়েক ধাপে বেড়েছে কাগজের দাম। এর প্রভাব পড়েছে সবধরণের শিক্ষা উপকরণের উপর। দিন দিন লাইব্রেরী ও স্টেশনারী ব্যবসায়ীদের মুনাফা কমছে। কারণ খাতা-কলম সহ শিক্ষা উপকরণের দাম যেভাবে বাড়ছে আমরা সেভাবে মুনাফা করলে সাধারণ মানুষের কি হবে। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে সকল পণ্যের দাম বাড়ছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষা উপকরণের দাম। অথচ প্রতি বছর বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি সহ ভর্তুকির কথা আমরা শুনি। কিন্তু এর বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাইনা। শিক্ষা উপকরণ তৈরী ও আমদানীতে ভর্তুকি বাড়ালে অন্তত শিক্ষাখাতে কিছুটা উপকৃত হবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকমহল।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি সিলেটের সভাপতি ও পপি লাইব্রেরী সিলেটের স্বত্তাধিকারী গোলজার আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম এখন বাড়তির দিকে। এর প্রভাব শিক্ষা উপকরণের উপর পড়েছে। বইয়ের দাম তেমন বাড়েনি। তবে আগামীতে নতুন বই আসলে দাম বাড়বে। খাতা কলম সহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের দাম কিছুটা বেড়েছে। আমরা নামমাত্র লাভে শিক্ষা উপকরণ বিক্রি করছি। শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি যৌক্তিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বাংলাদেশের সবকিছুতেই মূল্যবৃদ্ধি নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপরও স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্ট উপকরণের দাম বাড়ানোর ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের একটু ভেবে দেখা উচিত। কাগজ, কলম ও বই এই ৩টি জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এসব উপকরণ উৎপাদন ও আমদানীখাতে ভ্যাট ট্যাক্স প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। আসন্ন বাজেটে শিক্ষাখাতের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখা উচিত।