সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যা ও প্রতিকারে করণীয়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২২, ৭:৩৩:৪২ অপরাহ্ন
ইমতিয়াজ রফিক চৌধুরী
আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশের মানুষ বন্যা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে পরিচিত। ভৌগলিক অবস্থান, ভূ- প্রকৃতি এবং আবহাওয়া বা জালবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশে নিয়মিত বন্যা হয়। প্রচুর বৃষ্টিপাত সমুদ্রের কুল ভাসানো প্রচন্ড তরঙ্গ- নদীর তলায় জমে থাকা পলির ফলে নদীগর্ভে অল্প পানি ধারণের ক্ষমতা- ভূ প্রাকৃতিক ভূমিকম্প, জোয়ার ভাটা এবং যথাযথ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা অথবা ভূল নিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্যার মূল কারণ হলেও বন্যা শব্দের সাথে সাথেই আমাদের মনে যেটি উদিত হয় সেটি হলো অতিবৃষ্টি বা একনাগাড়ে কয়েকদিন ধরে মুলষধারে বৃষ্টিপাত।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ৪০৫ টি নদী বয়ে গেছে, হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া প্রায় সবগুলোরই উৎপত্তিস্থল দেশের বাহিরে অথবা হিমালয় পর্বতে। বর্ষায় মেঘ মধুর আকাশের বর্ষণে নদীগুলো যখন প্লাবিত হয় তখন নদীর দৃশ্য চিত্তকে বিমোহিত করলেও দিন রাত অবিশ্রান্ত বর্ষণে যখন নদীর কূলছাপিয়ে শস্যক্ষেত, বাড়িঘর ডুবে যায় তখন দুঃখ দুর্দশার সীমা থাকে না।
বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ এলাকাই প্লাবন ভূমি এবং অর্ধেকেরও বেশি জায়গার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট হতে মাত্র আট মিটার উঁচু। একারণে বর্ষাকালে সাধারণত অতিবৃষ্টির কারণে নদীর পানি বাড়তে থাকে এই পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে, ফলে নিচু এলাকা যেমন- হাওর, বিল, ঝিলগুলো বৃষ্টির পানি দ্বারা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় এবং নিচু এলাকাগুলো সহজে প্লাবিত হয়।
এপ্রিল- মে মাসে সিলেটের নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং প্রাক- বন্যার সৃষ্টি করে এছাড়া জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসেও বন্যা হয়। সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, খোয়াই, কংশ, যদুকাটা ইত্যাদি নদীর বন্যার পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং নেত্রকোনা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া অঞ্চলেও বন্যার সৃষ্টি করে।
সিলেটের প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার জন্ম হয়েছে ভারতের বরাক নদী হতে। মনিপুর পাহাড়ের মাও সাংসাং হতে বরাক নদীর উৎপত্তি। এটি মনিপুর, মিজোরাম আসাম হয়ে বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে জকিগঞ্জ উপজেলা দিয়ে, এর পর এটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে একটি সুরমা ও অন্যটি কুশিয়ারা নাম ধারণ করে। যার মধ্যে সুরমা জকিগঞ্জ হতে কানাইঘাট হয়ে গোলাপগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা হয়ে সিলেট শহরের একপাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। অন্যদিকে কুশিয়ারা জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ এর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারা আবার হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে মিলিত হয়ে কালনী নাম ধারণ করে এবং ভৈরববাজারের নিকট মেঘনা নাম ধারণ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
অন্যদিকে মেঘালয়ের উমগট নদী যেটিকে ডাউকি নদীও বলা হয় সেটি জাফলং এসে গোয়াইন নদী নাম ধারণ করে বাউরভাবে সারি গায়াইন নাম নিয়ে ছাতকের কাছে কালকুয়া বাজার এলাকায় সুরমার সাথে মিলিত হয়ে সুনামগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহিত। মেঘালয়ের আরো একটি নদী উমনগি সুনামগঞ্জ শহরের কাছে সুরমার সাথে মিলিত হয়েছে। এছাড়া আরও অসংখ্য নদী ছড়া ও খাল পুরো সিলেট বিভাগ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যে গুলোতে ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ী রাজ্যের পানি বয়ে যায়। এই মে মাসে সিলেটে কয়েকদিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, এর চেয়েও বেশি বৃষ্টি হয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি ও আশপাশ এলাকায়। মেঘালয় ছাড়াও আসাম, মনিপুর ও মিজোরামে প্রচুর বৃষ্টিপাতের পানি নদ নদী দিয়ে দেশে প্রবেশ করে সিলেট শহর ও তার আশেপাশের উপজেলায় ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। সিলেট শহরের একতৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ প্রায় এক সপ্তাহ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। যদি ও এবারের বন্যার মাত্রাটা কিছুটা বেশি কিন্তু প্রতি বছরই সিলেট শহর ও আশে পাশে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পাহাড়ী ঢলে সুরমা নদী ভরপুর থাকায় শহরের বিভিন্ন ছড়া ও ড্রেনের পানি নামতে বিলম্ব হচ্ছে ফলে অনেক সময় বন্যা দেখা দিচ্ছে। অনেকে সিলেটের শহরের পানি নিষ্কাশনের আওতায় উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুললেও মূল সমস্যা হচ্ছে সুরমা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া।
সিলেট শহরের ১৩ টি বড় ছড়ার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৩ কি.মি. যার মধ্যে প্রায় ৩০ কি.মি: সিলেট সিটি কর্পোরেশন উদ্ধার করে ফেলছে। আরও উদ্ধারের কাজ চলছে। তাছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা মানুষকে স্বস্তি এনে দিলেও সুরমা নদীর নাব্যতা না থাকায় এর সুফল পুরোপুরি মিলেছে না। ২৪৯ কি.মি দের্ঘ্যওে সুরমা নদী, পলি, বালু, প্লাস্টিক ও নাগরিক বর্জ্যে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় এর উৎসমুখে প্রায় ৩৫ টি চর জেগেছে এবং এগুলো আরো বাড়ছে। একারণে প্রায় ৭০% পানি কুশিয়ারায় চলে যাচ্ছে ফলে নাব্যতা হারিয়ে শীত মৌসুমে সুরমা নদীতে ফুটবল ক্রিকেট খেলা শীতকালীন চাষাবাদ চলছে আর বর্ষা মৌসুমে সহজেই দুকূল চাপিয়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে।
এছাড়া ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে শিল্পায়ন ও অবাধে গাছ উজাড়ের কারণে মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এজন্য পাহাড়ি ঢলের সময় প্রচুর বালি- পলি পাথর নেমে আসায় নাব্যতা হারাচ্ছে নদী এই সমস্যা দিন দিন আরো ব্যাপক আকার ধারণ করছে।
সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হলো নদীকে বাঁচাতে হবে যাতে শীতকালে নদীর প্রবাহ সচল থাকে এবং বর্ষাকালে অধিক পরিমাণে পানি ধারণ করে প্রবাহিত হতে পারে। এজন্য বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার তার মধ্যে-
১। ভরাট হয়ে যাওয়া নদী দ্রুত খনন করে নাব্যতা বাড়াতে হবে।
২। উৎস মুখের চরগুলো সরিয়ে ফেলা এজন্য ভারত সরকারের সাথে যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩। নদীর তীরে- বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা প্রকোপ কমিয়ে আনতে হবে।
৪। বৃষ্টির পানি যাতে দ্রুত বড় বড় নদীতে নেমে আসে সেজন্য যথেষ্ট সংখ্যক খাল ও নালা খনন করতে হবে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা যেতে পারে।
৫। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের যৌথ প্রচেষ্টার বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে হবে।
সর্বোপরি জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে অন্যথায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সুফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে বাড়েেব ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ, ঘটবে পরিবেশ বিপর্যয়। দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমা সহ অন্যান্য নদীগুলো পরিণত হবে মরা গাঙ্গে।
লেখক : প্রভাষক, পদার্থ বিজ্ঞান, শাহজালাল জামেয়া স্কুল এন্ড কলেজ।