সংকুচিত দীঘিতেই নান্দনিক ওয়াকওয়ে!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুন ২০২২, ৫:০০:১৬ অপরাহ্ন
উদ্বোধন শনিবার, আসছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভারতীয় হাই কমিশনার
এমজেএইচ জামিল : দীর্ঘদিনের পুরনো ধোপাদিঘী সংকুচিত থেকেই ফিরছে নতুন রুপে। দিঘীকে কেন্দ্র করে তৈরী হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে। নিকট অতীতে নগরীর বিভিন্ন জলাধারকে কেন্দ্র করে নির্মিত ওয়াকওয়ের বর্তমান পরিণতি দেখে ধোপাদিঘীর ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত সিলেটের পরিবেশবিদগন।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে ভারতের আর্থিক অনুদানে ইতোমধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ধোপাদিঘী ওয়াকওয়ের। আগামী শনিবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও ভারতীয় হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। সাথে উদ্বোধন হবে ভারতের আর্থিক অনুদানে নির্মিত ৬ তলা বিশিষ্ট চারাদিঘীরপার স্কুল ও কাষ্টঘর সুইপার কলোনীর।
সিলেটকে বলা হতো দীঘির শহর। তবে এখন দিঘীর নামে স্থান থাকলেও কেবল থাকছেনা দীঘি। এসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধোপাদিঘী। এক সময়ে শকুনের নজর পড়েছিল দীঘিটির উপর। বেদখল হয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছিল ঐতিহ্যবাহী এই বড় দীঘিটি। বেদখল থেকে দীঘিটি উদ্ধার করে সিলেট সিটি কর্পোরেশন। তবে এখনো পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি দীঘির সম্পূর্ণ জায়গা। দীঘি ঘেঁেষ এখনো রয়ে গেছে শিশুপার্ক। অথচ দীঘির পাড়ের প্রশ^স্ততা বাড়ানো কিংবা দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে তৈরীর আগে শিশুপার্ক অপসারণ করা উচিত ছিল বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। আইনীভাবে শিশুপার্ক অপসারণ করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কিন্তু সিসিক কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যিক চিন্তাধারায় প্রশ^স্তের বদলে সঙ্কুচিত হয়ে ফিরেছে ধোপাদিঘী। ওয়াকওয়ে চালু হওয়ার পর ফের একে একে হারিয়ে যাবে দীঘিটি। এমনটা মনে করছেন পরিবেশবাদীগণ। তারা বলেন, ইট পাথর বালু দিয়ে ঘেরা স্থাপনায় সৌন্দর্য্যবর্ধন হলেও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ হয়না। নগরীতে যতটি দীঘি হারিয়ে গেছে সবদিঘীর উপরই গড়ে উঠেছে স্থাপনা। সবকিছুর মূলেই রয়েছে বাণিজ্যিক চিন্তাধারা। পরিবেশ সংরক্ষণ ও বাণিজ্যিক চিন্তাধারা একসাথে চলেনা।
জানা গেছে, বেদখল হওয়া ধোপাদিঘী উদ্ধারে ২০১৮ সালে সক্রিয় হয় সিলেট সিটি কর্পোরেশন। তখন সিসিকের কঠোর উচ্ছেদ অভিযানের ফলে দিঘীর চারদিকে দৃশ্যমান অনেক স্থাপনা অপসারণ হয়। অস্তিত্ব সঙ্কটে থাকা ধোপাদিঘীর পুনরুদ্ধারে সিসিকের উদ্যোগ সকল মহলে প্রশংসিত হয়। এক পর্যায়ে মৃতপ্রায় ধোপাদিঘীকে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করে সিসিক। সেই অনুযায়ী শুরু সৌন্দর্য্যবর্ধন কাজ। দিঘীর উপর দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা সহ দিঘীর মাঝখানে রেষ্টুরেন্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিটি কর্পোরেশন। আর্থিক অনুদানে উৎসাহ দেখায় ভারত। ফলে ধোপাদিঘীকে ঘিরে শুরু হয় নতুন পরিকল্পনা। এসময় সিলেটের পরিবেশবাদীরা মূল দিঘীর আয়তন সংকুচিত করে স্থাপনা নির্মাণ এবং দিঘীর মাঝখানে রেষ্টুরেন্ট স্থাপনের বিরোধীতা শুরু করেন। একটি পর্যায়ে রেষ্টুরেন্ট নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সিটি কর্পোরেশন।
ধোপাদিঘীর পাড়ের সৌন্দর্য্যবর্ধনের জন্য গ্রহণ করা হয় ‘ধোপাদিঘী এরিয়া ফর বেটার এনভায়মেন্ট এন্ড বিউটিফিকেশন’ প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করে ‘ডালি কনস্ট্রাকশন’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে শতভাগ কাজ শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দীঘির চারদিকে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াকওয়ে। দর্শনার্থীদের বসার জন্য স্থাপন করা হয়েছে বেঞ্চ। পুকুরে নামার জন্য বসানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ঘাট। পুকুরের নোংরা পানি পরিষ্কার করার কাজ চলছে। বৃক্ষপ্রেমীদের পরামর্শে সবুজ বৃক্ষ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওয়াকওয়ে ঘেঁেষ নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক টয়লেট। এসব টয়লেট ও বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার জন্য রয়েছে আলাদা পাইপলাইন। নির্মিত টয়লেটের পাইপলাইনের সংযোগ পুকুর থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। পুকুরপাড়ে সিটি কর্পোরেশন নির্মিত মসজিদের উত্তর পাশে রাখা হয়েছে প্রবেশ পথ। লোকজনের হাটাচলার জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে ওয়াকওয়েটি। দিঘীর চারদিকের ওয়াকওয়েতে রয়েছে আলোকসজ্জা। সবমিলিয়ে একটি ধোপাদিঘীর পাড়ে একটি নান্দনিক ওয়াকওয়ে গড়ে উঠেছে ঠিকই। তবে কিছুদিন পর অন্যান্য ওয়াকওয়ের মতো ধোপাদিঘীর বুক চিরে গড়া উঠা ওয়াকওয়েও পরিত্যক্ত স্থান ও মাদকসেবীসহ অপরাধীদের নিরাপদ অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে সিলেটের পরিবেশবাদীগণ। তাদের দাবী অন্যসব ওয়াকওয়ে থেকে ধোপাদিঘীর স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট রয়েছে, বাণিজ্যিক চিন্তাধারার কারণে যেন কোনভাবে দিঘীর স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট না হয়।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, প্রাকৃতিক কোন স্থানের উপর ইট বালু দিয়ে গড়ে তোলা স্থাপনা কোনভাবেই পরিবেশ বান্ধব হয়না। কারণ পুকুরের তলদেশ এবং পাড়ে মাটি থাকবে, পাকা নয়। সেখানে জলজ প্রাণী থাকবে লাইট নয়। আর এটাই শতভাগ প্রাকৃতিক। ধোপাদিঘী নিয়ে আমাদের এমনটাই দাবী ছিল।
সিলেট সিটি কর্পোরেশন ঐতিহ্যবাহী একটা পুকুরের উপর রংচং দিয়ে যে উজ্জল্য সৃষ্টি করেছে, সেটা বেশিদিন থাকবে বলে মনে হয়না। বিশেষ করে বৃষ্টিবহুল সিলেটে এসব স্থাপনা রং হারিয়ে কিছুদিন পরে বিশ্রি রুপ ধারণ করে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষন না হলে এগুলো একসময় অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় স্থলে পরিনত হয়। সিলেটের অনেক স্থাপনা আজ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে। সিলেটের কৃতিসন্তান জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নামে দীঘির পাড়ে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছে শিশুপার্ক নামক যান্ত্রিক দানবীয় প্রতিষ্ঠান। সিটি কর্পোরেশন চাইলে আইনীভাবে সেটা উচ্ছেদ করে দীঘির পাড়ের প্রশ^স্ততা বাড়াতে পারে। একই সাথে দীঘির পশ্চিমপাড়ে জেলের দেয়াল ঘেঁেষ শিশুদের আনন্দ বিনোদনের জন্য ছোটখাটো একটা বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন করা যায়। এতে দীঘি সঙ্কুচিত না হয়ে আরো প্রশস্ত হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, যেহেতু এটার নাম ধোপাদিঘীর পাড়। সেক্ষেত্রে আগে দিঘীকে প্রাধান্য দিতে হবে। তারপর আসবে স্থাপনা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নামটা শুধু দিঘীর আর গুরুত্বপাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে। আমাদের দাবী ছিল দীঘির সীমানা ঠিক রেখে স্থাপনা নির্মাণ। সিলেট সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক পুকুরের পাড়ে নির্মিত পরিবেশ বিধ্বংসী বাণিজ্যিক শিশুপার্ক উচ্ছেদ করতে পারেনি। দীঘি সঙ্কুচিত করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। কয়দিন পর সেটা লিজ দেয়া হবে। সেখানে সবকিছু হবে বাণিজ্যিক। নগরীর অন্যান্য ওয়াকওয়েগুলোতে প্রথমে দৃষ্টিনন্দন হিসেবে মানুষের কাছে প্রিয় ছিল। রং চলে গেছে। সেগুলো এখন অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। ধোপাদিঘীর পাড় ওয়াকওয়ে লিজ দেয়া হলে সেখানেও কিছুদিন পর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবেনা এর কোন গ্যারান্টি নেই। এতে পূর্বের ন্যায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়তে পারে ঐতিহ্যবাহী দিঘীটি।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, পরিবেশবাদীদের দাবী ছিল আমরা রেষ্টুরেন্ট করবোনা। আমরা সেটা করিনি। পুকুরের তলদেশও পাকা করিনি। পরিত্যক্ত একটা পুকুরকে সুন্দর রুপ দিয়েছি। রক্ষণাবেক্ষনের স্বার্থেই ধোপাদিঘীর পাড় ওয়াকওয়ে লিজ দেয়া হতে পারে। লিজ দেয়া না হলে এর সৌন্দর্য্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
লিজ দেয়ার কারণে অন্যান্য ওয়াকওয়ে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। এটাও কয়দিন পর এমন হতে পারে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লিজ দেয়া না হলে এর পরিবেশ ও সংরক্ষণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। এর সৌন্দর্য্য রক্ষার দায়িত্ব শুধু সিটি কর্পোরেশনের একার নয়। পুরো নগরবাসীকে নগরীর সৌন্দর্য্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।