সিলেটে জনারন্য স্মরণ সভা : আপন গুণে জীবনভর আলো ছড়িয়েছেন মুহিত
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুন ২০২২, ১:০১:৫৭ অপরাহ্ন
সিলেটের সন্তান হলেও তার মধ্যে আঞ্চলিকতা ছিল না : পরিকল্পনামন্ত্রী
তিনি নীতির প্রশ্নে আপোষ করেননি কখনো : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
স্টাফ রিপোর্টার :
আলোকিত সিলেট বিনির্মাণের শ্লোগান নিয়ে তিনি সিলেটের রাজনীতি আবির্ভূত হয়েছিলেন। শুধু সিলেট নয় বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি নানাভাবে কাজ করে গেছেন। দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। অর্থমন্ত্রী হয়েও তার মানবিকতাবোধ, সচেতনতাবোধ, সততা, বয়সকে হার মানিয়ে কাজ করে যাওয়ার যে অদম্য শক্তি, নানামুখি ভাবনা এসব তাকে আর সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। আপন গুণে তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে আলোর দিশারী হয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাজেটের প্রণেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে স্মরণ ও তাঁর কর্মময় জীবন নিয়ে আলোচনায় এসব কথা বলেছেন বক্তারা। গতকাল শুক্রবার বিকেলে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগ’-এর ব্যানারে এই স্মরণ সভার আয়োজন করেন বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। মূল আলোচক ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছোটভাই, সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের সদস্যসচিব আহমেদ নূরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের আহ্বায়ক সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার আরশ আলী। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। এরপর সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তাঁর বোন ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহেলা খাতুন, ছোটবোন শিপা হাফিজ।
অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রীর স্মৃতিচারণ করে তাঁর সাবেক সহকর্মী ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘তিনি সিলেটের সন্তান হলেও তার মধ্যে আঞ্চলিকতা ছিল না। নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকে তিনি সবসময় দেশকে নিয়ে ভাবতেন। সবার জন্য চিন্তা করতেন।’ তার নানামুখি কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একই মন্ত্রণালয়ে তাঁর অধিনে কাজ করার সময় তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁর মতো কর্মমুখর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আরেকজন খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমি তার অধীনে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। সেজন্য আমি সৌভাগ্যবান। আমাদের সমাজে আঞ্চলিকতার বিষয়টি থাকলেও আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন তা থেকে মুক্ত। তিনি দেশের প্রতিটি এলাকার উন্নয়নে কাজ করেছেন। যা আমাদের জন্য বড় শিক্ষা।’
বড় ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে পররাষ্ট্রম্নত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘মুহিত ভাই আপাদমস্তক সৎ মানুষ ছিলেন। আদর্শ থেকে কখনই বিচ্যুত হননি। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপোষ করেননি।’ তিনি প্রধামন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর মতো স্পিডি ও কাজ পাগল মানুষকে খুঁজে এনে সঠিক জায়গায় কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন বলে তিনি দেশে ও মানুষের জন্য কাজ করতে পেরেছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমাদের পরিবার কৃতজ্ঞ।’
এর আগে বড় ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণে মুহিতের ছোট বোন শিপা হাফিজ বলেন, ‘বিগত কয়েক মাস ধরে মুহিত ভাই আমাদের সবাইকে বলছিলেন এপ্রিলে মাসে সিলেট যাবে আব্বার জন্মদিন। তোমরা আমার সব ভাইবোন আমার সঙ্গে যাবে। আমরা তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম আব্বার জন্মদিন তো জুন মাসে। এপ্রিলে নয়। কিন্তু তিনি কখনো সেটা শুনেননি। কিন্তু আমরা এপ্রিল মাসেই তাঁর সঙ্গে সিলেট আসলাম, তার মরদেহ নিয়ে। আবার জুন মাসে আজকে আবার সিলেট আসলাম, তাঁর স্মরণ সভায়।’ মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধতার কথা জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘মুহিত ভাই যখন মন্ত্রীত্ব থেকে বিদায় নিলেন। তার ক্ষমতা যখন আর নাই তখনও দেখেছি মানুষ তার কাছে এসে ভিড় করেছেন। তার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন। এ থেকে বুঝা যায় তিনি মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছিলেন।’ সিলেটে এমন আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ এখানে এসে আবার বুঝলাম সিলেটের মানুষ তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।’
সভায় বক্তব্য রাখেন, সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহজনেওয়াজ মিলাদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদ, সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি বেদানন্দ ভট্টাচার্য, জাসদ সিলেটে জেলা সভাপতি লোকমান আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ফজলুর রহমান, সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ, সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহিউদ্দিন আহমদ সেলিম, সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ফালাহ উদ্দিন আলী আহমদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বড় গুণ ছিল তিনি খুব ভালো শ্রোতা ছিলেন। এত প্রজ্ঞার অধিকারী হয়েও তিনি অন্যের কথা গভীর মনযোগ দিয়ে শুনতেন। যা এখন মানুষের মধ্যে তেমন একটা দেখা যায় না।’ মুহিতের কর্মময় জীবনের কথা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, ‘তিনি তার দীর্ঘ বর্ণময় জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে দিনরাত কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নানামুখি প্রচেষ্টা ও কাজের কারণে তিনি তখন ৪ ঘন্টার বেশি ঘুমাতেন না। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীসময়ে দেশের অগ্রযাত্রীয় নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন। সবচেয়ে বেশি বাজেটের প্রণেতা যেমন তিনি তেমনি বাংলাদেশে পরিবেশ আন্দোলন শুরু হয়েছে তার মতো কয়েকজনের হাতে।’
শুরুতে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে গোবিন্দ রায় সুমনের করা তথ্যচিত্র ‘লিজেন্ড’ প্রদর্শিত হয়। এরপর তাঁর জীবনী পাঠ করেন অধ্যাপক শামীমা চৌধুরী। এরপর এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে এই গুণী ব্যক্তিকে স্মরণ করা হয়। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রানা কুমার সিনহার শোক সঙ্গীতের মাধ্যমে মূলপর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়।
এর আগে সকাল সাড়ে এগারোটায় সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের নেতৃবৃন্দ নগরের শিবগঞ্জে আবুল মাল আবদুল মুহিতের কবর জিয়ারতে যান। এসময় দোয়া ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তারা।