সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার ভয়াবহতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০২২, ২:৪০:২২ অপরাহ্ন
# ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি
# মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা
# অনিশ্চয়তায় এসএসসি পরীক্ষার্থীরা
স্টাফ রিপোর্টার : অতি ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এক মাসের মাথায় আবারো পানিতে ভাসছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। দুই জেলার নদীগুলোর পানি সময়ের ¯্রােতের মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীর তীর উপচে নতুন করে হাজার হাজার বাড়িঘরে পানি ঢুকছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অন্তত: ১০ লাখের বেশী মানুষ। দূর্গত এলাকায় প্রয়োজনীয় খাদ্য ও উদ্ধার তৎপরতা না থাকায় মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্রে পানি উঠায় এসএসসি পরীক্ষার্থীরা পড়েছেন চরম অনিশ্চতায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সিলেট জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বেড়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৩ সেন্টিমিটার এবং সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার শূন্য দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর বাইরে জেলার ছোট ছোট অন্যান্য নদীর পানিও ক্রমশ বেড়ে বিপদসীমা অতিক্রম করছে।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট নগরের ২০ থেকে ৩০টি এলাকা ছাড়াও জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, বিশ^নাথ ও সিলেট সদর উপজেলার অন্তত ১ হাজারেরও বেশী গ্রাম এরই মধ্যে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলারও হাজারের উপরে গ্রাম পানির নিচে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। এসব এলাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে অসংখ্য জনপদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে পানি উঠায় কোম্পানিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সিলেট ও সুনামগঞ্জে অন্তত: ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় অন্তহীন দুর্ভোগে দিন পার করছেন। এ সংখ্যা আরো বেশীও হতে পারে।
এদিকে, বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ায় শিক্ষার্থীরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগও নেই। বন্যার পানিতে অসংখ্য পরীক্ষাকেন্দ্র ডুবে যাওয়ায় সেখানে পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া হবে, তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ পরিস্থিতিতে আগামী রোববার থেকে অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে দ্বিতীয় দফায় আবার গত বুধবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে দুটি জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার নির্ধারিত অসংখ্য কেন্দ্রেও পানি ঢুকে পড়েছে। এতে চরম অনিশ্চতায় পড়েছেন এসএসসি পরীক্ষার্থীরা।
সিলেট শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বোর্ডের অধীন থাকা চার জেলায় এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী রয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৪৭৩ জন। এর মধ্যে বন্যাকবলিত জেলা সিলেটে ৪৩ হাজার ৮৪৪ জন ও সুনামগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫২ জন পরীক্ষার্থী আছে। ৪ জেলায় ১৪৯টি পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটে ৫৯টি ও সুনামগঞ্জে ৩৩টি পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। তবে বন্যা পরিস্থিতিতে কী পরিমাণ পরীক্ষাকেন্দ্র প্লাবিত হয়েছে কিংবা কতসংখ্যক পরীক্ষার্থী পানিবন্দী আছে, এ রকম কোনো পরিসংখ্যান শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানাতে পারেনি।
স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বানভাসি এলাকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট নগরসহ জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও সিলেট সদর উপজেলা এবং সুনামগঞ্জের সদর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার বেশির ভাগ বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। এসব এলাকার বেশির ভাগ পরীক্ষাকেন্দ্র বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলার ৩৬৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ থাকবে। বৃহস্পতিবার বিকেলে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা এ তথ্য দিয়েছেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাখাওয়াত এরশেদ বলেন, জেলায় ১ হাজার ৪৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ২৩০টি বিদ্যালয় পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর বাইরে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে, সেগুলোতেও পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।
সিলেটের জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট ৬০৭টি উচ্চবিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা আছে। এর মধ্যে বন্যাকবলিত হয়েছে ১৫০টি। এর মধ্যে ১৩৭টিতে বন্যায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এর বাইরে ৫৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় সেখানেও পাঠদান বন্ধ আছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত জানান, স্থানীয় প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির দিকে সার্বিক নজরদারি রাখছেন। প্রয়োজনীয় স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার প্রায় সব উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। অসংখ্য রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। জেলা সদরের সঙ্গে পাঁচটি উপজেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের অধিকাংশ এলাকা এখন প্লাবিত। সুনামগঞ্জের সব কটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রথম দফা বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই এখন আবার দ্বিতীয় দফায় বন্যায় মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। ২০০৪ সালের পর শহরে এভাবে আর কখনো এত পানি হয়নি বলেও জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ছাতকে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ২ দশমিক ১৩ সেন্টিমিটার ওপরে আছে। সুনামগঞ্জে বুধবার সকাল ৯টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৮০ মিলিমিটার। একই সঙ্গে উজান থেকে নামছে পাহাড়ি ঢল। এতে জেলার নদ-নদীর পানি বাড়ছে।
এদিকে, সিলেটে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আজ ১৭ থেকে ১৯ জুন ভারী বর্ষণ হতে পারে। এছাড়া বাকি দিনগুলোতে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।