আমরা কি আসলেই মানবিক হতে পেরেছি?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুন ২০২২, ৬:৫৫:০৮ অপরাহ্ন
-:: আরণ্যক শামছ ::-
প্রবল বন্যায় বিপর্যস্ত পুরো সিলেট বিভাগ। মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট ও হাহাকারে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। এমন অবস্থায় ও সুযোগ-সন্ধানীরা বসে নেই। রিক্সা ও সিএনজি ড্রাইবারদের দৌরাত্ম্য অসীম। বরাবরই সিলেটের মানুষ এদের অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে মাথায় তুলে রাখে। আর বারবার মাশুলও দেয়। তবুও শিক্ষা হয়না। যেখানে ১০ টাকার ভাড়া, সেখানে দেওয়া হয় ৩০ টাকা। আর এই মহাবিপর্যয়ের সময় বরাবরের মতই বেরিয়ে আসছে তাদের আসল চেহারা। মায়া মমতায় হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠা এ সকল মানুষ দানব হয়ে উঠেছে। গৃহবন্দি অবস্থায় ব্যালকনি দিয়ে দেখলাম বুকসমান পানিতে জরুরি প্রয়োজনের তাগিদে বের হয়েছেন কিছু ভদ্র পরিবারের মহিলা। উপশহর বি ব্লক থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত ভাড়া বেশি হলে ২০ টাকা হতে পারে। দেখলাম দাবি করছে ১০০-১৫০ টাকা। রীতিমত কাকুতি মিনতি করলেও থামছে না। আর সিএনজি ওয়ালাদের তো কথাই নেই। “উঠলে উঠেন, নয়তো ফোটেন।”- এ রকম ঔদ্ধত্য।
জিনিস পত্রের দাম আকাশছোঁয়া। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। প্রতিটি দোকানদার নিজ ক্ষমতাবলে দাম চার-পাঁচ গুন বাড়িয়ে নিচ্ছে। মানুষের বেহাল দশা। খাবার পানি নেই। বিদ্যুৎ নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। মোবাইল কমিউনিকেশন বন্ধ। গ্রামাঞ্চলে লাশ ভেসে যাচ্ছে নদীতে। শহরের মানুষ উদ্বাস্তু। পরিবার পরিজনদের বাঁচাতে মানুষ হোটেলে আশ্রয় নিতে চাচ্ছে। হোটেল মালিকদের মুখ দিয়ে লালা বেরুচ্ছে অর্থের লোভে। আমার এক বন্ধু ঢাকা থেকে এসেছে। ভাবলাম আপাতত হোটেলে ব্যবস্থা করে দেই। এই হোটেল কর্তৃপক্ষ কে ভালো করে চিনি। রিসেপশনে ফোন করে রুম চাইলাম। ব্যাখ্যা করলাম, বন্যায় আটকে পড়া একজন অতিথির জন্য রুম চাই।যে রুমের ভাড়া ২৫০০ টাকা, সেটা চাইলো ৪০০০ টাকা। পরে পরিচয় দিয়ে ধমক দিলে ম্যানেজার লাইনে এসে মাফ চেয়ে নরমাল ভাড়া নিলো।
অদ্ভুত শূন্যতা বুকে নিয়ে ভাসছে মানুষ গুলো। দিশেহারা। অনেকেই আছেন দূর দূরান্ত থেকে আসা বেসরকারি চাকুরিজীবি। এদের দেখার কেউ নেই। কর্তা ব্যক্তিরা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিংবা বাসায় জেনারেটর চালিয়ে আয়েসেই আছেন। উনাদের দেখার সময় কোথায়? উপরের চাপ না আসলে এ সব সাধারণ নাগরিকের নিম্নচাপ কে কোন বিপদ সংকেত হিসেবে ভাবাই হয়না। বন্যা উনাদের অফিস কামাইয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। অপ্রত্যাশিত সুখ। মাস শেষে বেতন আর ত্রাণ তহবিলের ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ বন্যায় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি একেবারেই নগন্য। এমপি মন্ত্রীরা রাজধানীতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন।
এ দিকে নৌকার মালিকরা ২০ টাকার ভাড়া ১৫০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাই ত্রাণ কর্মিরা এ সব হীনমনস্ক মানুষের অসহযোগিতার কারনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতেও পারছেন না। পাওয়া যাচ্ছে না নৌকা। সিলেটের জেলা প্রশাসক বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক নৌকা আমরা পাচ্ছি না।
সিলেট ও সুনামগঞ্জে প্রায় শতভাগ এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। শুক্রবার (১৭ জুন) সেনাবাহিনী পানিবন্দীদের উদ্ধারে নামে। পরে নামে নৌবাহিনীর সদস্যরা। এখনো হাজার হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে পারেননি। বিদ্যুৎ নেই, ফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। এমন অবস্থায় অসহায় মানুষগুলোকে উদ্ধারে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পানিবন্দীদের স্বজনেরা তাদের পাশেও দাঁড়াতে পারছেন না।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার বন্যাকবলিত মানুষের স্বজনেরা ভিড় করছেন সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর ঘাটে। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এই ঘাটে শতাধিক যাত্রীবাহী নৌকা ছাড়াও বালুবাহী নৌকাও বন্যাদুর্গতদের সরিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। কিন্তু নৌকার মালিক ও মাঝিরা সব নৌকার ভাড়া অন্তত শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সালুটিকর থেকে কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল গ্রামের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। স্বাভাবিক সময়ে এই পথটুকু নৌকায় যেতে আটশো থেকে এক হাজার টাকা খরচ হয়। এখন এই ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে মাঝিরা ভাড়া হাঁকছেন ৫০ হাজার টাকা।
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি থেকে সিলেট শহরে নিয়ে আসতে গিয়ে শুক্রবার বিকেলে এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন মারুফ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। তিনি ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হলেও নৌকার মাঝি রাজি হননি।
সালুটিকর ঘাটে জনপ্রতি হিসেবে আগে যে ভাড়া ২০ থেকে ৫০ টাকার ভেতর ছিল, এখন তা এক থেকে দেড় হাজার টাকায় ঠেকেছে। ভাড়া নিয়ে দরকষাকষির সুযোগও রাখছেন না মাঝিরা।
একই অবস্থা সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত প্রতিটি এলাকায়। সিলেটের ব্যবসায়ী ফরিদ আহমেদ জানান, আমার ড্রাইভারের পরিবার সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় গ্রামে পানিবন্দি হয়ে আছে। তাদের উদ্ধারে অনেক টাকা খরচ করেও একটা নৌকা ভাড়া করতে পারিনি। পরে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে গেছেন।”
এদিকে বন্যায় আটকে পড়াদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে সিলেট শহর থেকে অসংখ্য মানুষ সালুটিকর ঘাটে গেলেও অতিরিক্ত নৌকা ভাড়ার কারণে তারা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
শুক্রবার সিলেট শহর থেকে কিছু মাদরাসা শিক্ষার্থী লেগুনায় করে ত্রাণ নিয়ে সালুটিকর ঘাটে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের কাছে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া চাওয়া হয়।
এ ব্যাপারে আহসান হাবিব নামের একজন সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, “ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে নৌকা নিতে পারছি না।”
এমন একজন হচ্ছেন আব্দুল জব্বার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার। তার ভাষ্য, তিনি অতিরিক্ত ভাড়া দিতে রাজি ছিলেন। তারপরেও দুর্গত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি কোনো নৌকা পাননি।
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, “কিছুটা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও উদ্ধার কাজের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক নৌকা আমরা পাচ্ছি না। কিন্তু এত বেশি ভাড়া হাঁকা হচ্ছে বলে জানা ছিল না। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এ দিকে এই সুযোগে ডাকাতদল তৎপর হয়েছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় রাতে হানা দিয়ে মানুষের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। চরম অমানবিকতার এমন দৃষ্টান্ত এ দেশে কখনো হয়নি। মানুষ যেন হিংস্র হায়েনার মতো আচরন করছে। মানবতা আজ ভুলন্ঠিত। ছোট ছোট শিশুদের বানে ভাসা লাশ অন্তরাত্মা কে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
সাধারণত দেখা যায় জীবনের ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা মধ্যবিত্তরা তুলনামূলকভাবে মানবিক। ওরা দেখেছে জীবনের কদর্য রূপ। জীবনের পরতে পরতে। মানুষের দুর্ভোগ ও দুঃখ কষ্ট এদের স্পর্শ করে। এদের ভাবায়। সাধ্য না থাকলেও এরা সমব্যথি হয়। মমতার হাত বাড়ায়। উদ্বিগ্ন হয়।তাই এই মহাদূর্যোগের সময়ও আসেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ সব মানুষদের দেখেছি মানুষদের পাশে দাঁড়াতে। খবর নিতে। সাধ্যমতো সহায়তার হাত বাড়াতে। আমি নিজেও মধ্যবিত্তের ফাঁদে আটকে পড়া এক দু’পেয়ে প্রজাতির একজন। তবুও সাধ্যমতো চেষ্টা করি বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। এবারও নিজেও প্রবল বন্যাক্রান্ত হয়েও কিছু মহৎ বন্ধুদের সাথে কাজ করছি। কিন্তু অবাক হয়েছি এই ভেবে যে, যাদের কে আমরা সমাজের চিত্ত ও বিত্তশালী হিসেবে চিনি, তাদের হাত পা গুটিয়ে থাকা দেখে। সময় এসেছে এদের চিহ্নিত করার। বয়কট করার। এ সব মানুষের জন্যই সমাজের এ অবস্থা। এ সব সুবিধাভোগী নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। এরা প্রবঞ্চক। উনাদের উদ্দেশ্যে বলি: “যাদের ঘাড়ে পা দিয়ে দিয়ে উঁচুতে উঠেছেন, তাদের ভুলে গেলে চলবেনা। একদিন আপনাদের ও নামতে হবে। উপরে বেশি দিন থাকা যায় না। প্রকৃতি থাকতে দেয়না। যাদের ঘাড়ে পা দিয়ে উপরে উঠেছেন, তাদের কথা মনে রাখুন। কারন নামার পথে ওদের সাথে দেখা হবেই হবে।”
ধন্যবাদ জানাই দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের। যারা খবর নিয়েছেন। যোগাযোগ করেছেন। সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। পানির জার নিয়ে গলাপানি ভেঙ্গে বাসায় উপস্থিত হয়েছেন।
মহান আল্লাহর কাছে দোয়া ও প্রার্থনা করি, ‘হে মাবুদ, সকল বিপদগ্রস্ত মানুষ কে এ সংকট থেকে উদ্ধার করুন। আপনিই মানুষের একমাত্র ভরসা। অভয়াশ্রম। আমরা আপনার আশ্রয় চাই। আমাদের মুক্তির পথ দেখান। আর কিছু মানুষ কে হেদায়েত দান করুন। আমিন।”
-লেখক কলামিস্ট, অধ্যক্ষ, মুহিবুর রহমান একাডেমি।