‘স্যার আমরা কষ্টে আছি আমরার খাওয়া-দাওয়া নাই’
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জুন ২০২২, ৮:৩২:০৯ অপরাহ্ন
এ টি এম তুরাব : সিলেটের উপজেলার কুড়ারবাজার ইউনিয়নের বৈরাগীবাজার ও আব্দুল্লাপুর এলাকা। বন্যার শুরুর দিকেই ওই দুই গ্রামে যাওয়ার উঁচু সড়কটি তলিয়ে গেছে। গ্রামের ৯০ শতাংশ বাড়িঘরে এখন পানি উঠে গেছে। সেখানে কারো ঘরে হাঁটু পানি, কারো ঘরে কোমর পানি। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটে পড়েছে বন্যাকবলিত মানুষ। গতকাল বিকেলে প্রতিবেদকসহ স্থানীয় সংবাদকর্মীদের একটি দল নৌকা দিয়ে গ্রাম পরিদর্শনের সময় চোখে পড়ল আধাডোবা দু’চালা একটি টিনের ঘর।
ওই ঘরের ছবি তুলতে গেলেই ভাঙা টিনের ফোঁকর দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিলেন এক নারী। নৌকা দেখে তিনি আপ্লুত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘স্যার আমরা কষ্টে আছি। ঘরের চাঙের মধ্যে আছি। সাত-আটজন ফুয়া-ফুড়িন (ছেলে-মেয়ে) লইয়া বড়ো কষ্টের মধ্যে আছি। আমরার খাওয়া-দাওয়া নাই..।’
তিনি ভেবেছিলেন সরকারি লোকজনের কেউ ত্রাণ নিয়ে এসেছে। ষাটোর্ধ ওই নারীর নাম মায়ারুন নেছা (ছদ্মনাম)। বৃদ্ধ স্বামী, দুই ছেলে, ছেলেদের বউ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই ঘরে তার বসবাস। আকস্মিক বন্যায় তার ঘরের খাটের ওপর পর্যন্ত পানি উঠেছে। ঘরের ধান-চাল সব পানিতে তলিয়ে গেছে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল কোথায় গেছে জানা নেই। আশপাশের বাড়িঘরেও পানি। এ অবস্থায় ঘরের চাঙে তক্তা বিছিয়ে আশ্রয় নেন পরিবারটি। চার দিন ধরে তারা শুধু মুড়ি আর পানি খেয়ে আছেন। আর কোনো খাবার জুটে নাই।
ওই ইউনিয়নের আরো একটি গ্রামের নাম আঙ্গারজুর। ওই গ্রামের আরজুদা বেগমের (৪৫) বাড়িতে হঠাৎ করেই পানি ওঠে। আধা ঘণ্টার মধ্যে পানিতে ভেসে যায় ঘরের সব কিছু। সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে ভেজা কাপড়ে আশ্রয় নেন আরেকটি বাড়িতে। শুক্রবার থেকে এখন পর্যন্ত আছেন ওই কাপড়েই। তার ঘরেও খাবার নেই। একই গ্রামের বাসিন্দা সুলতান মিয়া (৬০)। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে তিনিও আশ্রয় নেন অন্যের বাড়িতে। এক আত্মীয় তাকে কিছু চাল দিয়ে যায়।
বৈরাগী বাজারের উত্তর পাশের গ্রাম খশিরবন্দ। বন্যার পানিতে এ গ্রামও তলিয়ে যায়। এ গ্রামের বন্যা কবলিতরা শুকনো খাবার খেয়ে দিন পার করছেন। গ্রামটিতে বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার চলছে। গভীর নলক‚প পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির জন্য এ হাহাকার। গ্রামের মতিউর রহমান বলেন, জীবনের সাথে যুদ্ধ করি আর পারতাছি না। খাওয়ার পানি নাই, ঘরে দানাপানি নাই।
মতিউর বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে একবার কেউ খবরও নেয়নি। মুড়ি আর পানি খেয়ে সবাই বেঁচে আছে। গতরাতে কয়েকজন ব্যক্তি নৌকা যোগে বাড়ি এসে কিছু খাবার দিয়ে গেছে। এখন মুড়িও নেই।
শুধু মায়ারুন নেছা, আরজুদা, সুলতান মিয়া কিংবা কুড়ারবাজার ইউনিয়ন নয়। জানা গেছে, বিয়ানীবাজার উপজেলার বন্যা কবলিত প্রতিটি ইউনিয়েনেই অবস্থা এখন এরকম। চুলা জ্বালানোর উপায় নেই। ঘরহারা এসব মানুষ না খেয়ে আছে। আছে খাবার পানি সঙ্কট।
সিলেট বিভাগীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম শহিদুল ইসলাম জানান, সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল। বুধবার বিকেলে ওই পয়েন্টে পানি ১৩ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। নদীর সিলেট পয়েন্টে পানির বিপদসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ছিল ১১ দশমিক ১৬ সেন্টিমিটার। বুধবার বিকেলে হিসাব অনুযায়ী সেখানে পানি ছিল ১১ দশমিক ১১ সেন্টিমিটার।
বিয়ানীবাজারে ১১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ :
সিলেটের বিয়ানীবাজারে বন্যা কবলিত হওয়ার উপজেলার ১১২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় ৩৪টি বিদ্যালয় অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খোলা হয়েছে। বুধবার বিকালে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার বেশীরভাগ এলাকা পানির নীচে তলিয়ে আছে। কুশিয়ারার একাধিক ডাইক ভেঙ্গে এবং সুরমা ও সুনাই নদীর ডাইক উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার ৩০ থেকে ৩৫টি এলাকায় হু হু করে পানি বাড়ছে। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে কয়েকটি এলাকা। সময় সময় পানি বেড়ে চলছে বলে স্থানীয় লোকজন জানান। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দুবাগ, শেওলা, কুড়ারবাজার, মাথিউরা, তিলপাড়া ও মোল্লাপুর, ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। অপরদিকে সোনাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা, মুড়িয়া ও তিলপাড়া ইউনিয়নের বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সোনাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জলঢুপ-লাতু সড়কের অনেক স্থান তলিয়ে গেছে। একই সাথে নাওলা, দক্ষিণ পাহাড়িবহরসহ আশপাশ এলাকা ডুবে গেছে।
সার্বিক বিষয়ে বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশিক নূর জানান, বন্যা মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যাদের ঘরবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে তাদেরকে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আহবান জানান তিনি।