সিলেটের বাতাসজুড়ে কেবলই দীর্ঘশ্বাস
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০২২, ১:১৫:৫৩ অপরাহ্ন
বন্যায় ৪ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৬
বিপদসীমার উপরেই নদীর পানি
ত্রাণ পাচ্ছেনা প্রত্যন্ত জনপদের মানুষ
ঘুরে গেলেন সেনা, পুলিশ ও র্যাব প্রধান
জালালাবাদ রিপোর্ট : সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রতিটা গ্রামের বাতাসজুড়ে এখন মানুষের করূণ দীর্ঘশ্বাস। তাদের আহাজারী ও সমুদ্রসমান কষ্টের চিত্র চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। বন্যার পানির স্রোতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। হাজার হাজার বাড়িঘর নিমিষেই বিধ্বস্ত হয়েছে। গ্রামে এমন কোনো ঘর নেই, যেটি বন্যার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। শুধু ঘরবাড়ি নয়। ধ্বংস হয়ে গেছে দোকানপাট, গাছপালা। বাড়িঘরের আঙিনা, সড়কে বিপদজনক গর্ত হয়ে গেছে। ঢলের সঙ্গে নামা বালুর স্তূপ জমে আছে সবখানে। যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দুই জেলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তর।
এমন দীর্ঘশ্বাসের মাঝে বন্যায় সিলেটে মৃতের সারিও ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, বন্যায় সিলেট বিভাগে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ১৬ জন, সুনামগঞ্জে ২৬ জন, হবিগঞ্জে ১ জন ও মৌলভীবাজারে ৩ জন রয়েছেন।
মৃতের সারির মাঝে খাদ্য সংকটে অভূক্ত অসংখ্য মানুষ। সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে বন্যার্তরা ত্রাণ পাচ্ছে না। পানিতে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় গ্রামের অনেকের উপার্জন বন্ধ। যে খাবার মজুত ছিল, তা-ও শেষ। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামের বানভাসি মানুষেরা খাদ্যসংকটে ভুগছে। অথচ সহজে যাওয়া যায়, বিশেষ করে শহরের অনেক এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা বেশি।
কোম্পানীগঞ্জের এক স্বেচ্ছাসেবী জানান, বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, কিন্তু এ কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ফলে যারা পাচ্ছে তারা প্রচুর পরিমাণে পাচ্ছে। আবার অনেকে একেবারেই পাচ্ছে না, তারা খুব সংকটে রয়েছে।’ আর এ চিত্র কেবল কোম্পানীগঞ্জের নয়, সবখানেই।
অভূক্ত মানুষের এক চিত্র উঠে এসেছে গতকাল। সুনামগঞ্জ লঞ্চঘাট এলাকার আশেপাশে বাস করে ১০ বছরের শিশু জীবন। কোস্ট গার্ডের বোট দেখে দৌড়ে এসে সে ক্লান্ত-শ্রান্ত চেহারায় আকুতি জানায়, ‘স্যার, আমারে একটা প্যাকেট দিন। আমার ঘরে গলা পানি। খাবার না পেলে আমি মারা যাবো’।
শুধু জীবন নয়, শিশু থেকে শুরু করে নারী, পুরুষ ও বৃদ্ধ সবারই এখন ত্রাণের জন্য করুণ আর্তি আর আহাজারী।
সিলেট-সুনামগঞ্জের সবখানেই নৌযান দেখলেই ত্রাণের আশায় ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। কেউ সাঁতার কেটে কেউবা গলাসমান পানিতে নেমেও নৌযানের কাছাকাছি চলে যাচ্ছেন। তবে বেশিরভাগই ফিরছেন খালি হাতে। এমন অভিযোগ প্রায় সবখানেই।
এমন হাহাকারের মাঝেও সিলেটে বন্যার ভয়াবহতা কমেনি। পানির উপরে এখনো ভাসছে প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা। সুরমা অঞ্চলে নামেমাত্র উন্নতি হলেও কুশিয়ারা অঞ্চলে ডুবছে গ্রামের পর গ্রাম। নদীগুলোর অবস্থাও বিপদসীমার উপরে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় পানি ছিলো ১৩ দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল। বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে রয়েছে ১৩ দশমিক ৭৪ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে বুধবারের মতো গতকালও মতো পানি অপরিবর্তিত আছে। সেখানে পানি ১৭ দশমিক ২৮ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। শেওলা পয়েন্টেও পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। সেখানে পানি রয়েছে ১৭ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টেও অপরিবর্তিত অবস্থায় পানি ১০ দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটারে রয়েছে।
লোভা নদীর পানি লোভা ছড়া পয়েন্টে বুধবারের তুলনায় বেড়েছে। বুধবার ১৩ দশমিক ৮৮ সেন্টিমিটার থাকলেও বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ সেন্টিমিটার। সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টেও পানি বেড়েছে। বুধবারের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়ে বৃহস্পতিবার সকালে পানি ১১ দশমিক ১১ সেন্টিমিটারে রয়েছে।
ধলাই নদের ইসলামপুর পয়েন্টে নদীর পানি কমেছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১০ দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটার থাকলেও বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় কমে ১০ দশমিক ২২ সেন্টিমিটার হয়েছে। সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টেও আগের দিনের তুলনায় গতকাল পানি শূন্য দশমিক শূন্য ৭ সেন্টিমিটার কমেছে।
এদিকে, সিলেট-সুনামগঞ্জ ছাপিয়ে হবিগঞ্জে প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। আজমিরীগঞ্জ, নবীগঞ্জ, বানিয়াচং, লাখাই ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পর ডুবে গেছে মাধবপুর ও বাহুবল উপজেলা।
হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, সাত উপজেলার ৭৯ হাজার ৭২০ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে জেলার ৬৬৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা। বন্যাদুর্গতদের আশ্রয় দিতে ২২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
মৌলভীবাজারেও একই চিত্র। বাড়ছে পানি। জেলার কুলাউড়া রেলস্টেশন থেকে বরমচাল রেলস্টেশন এলাকার মধ্যে বন্যার পানিতে দুই জায়গায় রেললাইন তলিয়ে গেছে। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া ওই জায়গাগুলো দিয়ে কম গতিতে ট্রেন চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, চার জেলার প্রত্যন্ত জনপদে হাহাকারের মাঝে সুখবর হলো সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি কিছুটা কমেছে। তবে এখনো নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে ময়লা ও কালো পানি জমে আছে। তাই বন্যাকবলিত মানুষ এখনই বাড়িতে ফিরতে পারছে না। এদিকে নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীর পানি কমলেও অন্যান্য নদ-নদীর পানি কিছু পয়েন্টে বেড়েছে। আবার কিছু পয়েন্টে পানি স্থির রয়েছে।
নগরবাসী বলছেন, বৃহস্পতিবার যে পানি ঢুকছে, সেটা টিকে থাকার মতো ছিল না। মনে হয়েছে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে। নগরের মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ি, তালতলা, ঘাসিটুলা, শাহজালাল উপশহর, সোবহানীঘাট, ছড়ারপার, মেন্দিবাগ, মাছিমপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় এখনো পানি পুরোপুরি কমেনি।
এদিকে, এখন পর্যন্ত অসংখ্য সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গতকালও সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কে যান চলাচল শুরু হয়নি। তেলিখালে একটি সেতুতে ফাটল ধরেছে। দেবে গেছে কোম্পানীগঞ্জ থানা বাজার এলাকার আরেকটি সেতুর এপ্রোচ সড়ক। এতে ওই সড়ক দিয়ে বন্ধ রয়েছে যান চালচল। এছাড়াও যান চলাচল হচ্ছেনা সিলেট-সুনামগঞ্জের অসংখ্য গ্রামীণ সড়কে।
অন্যদিকে, এখনো বিদ্যুতবিহীন অন্ধকারে রয়েছে অনেক উপজেলা। বন্যার কারণে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রগুলোতে পানি ঢুকে পড়ায় এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছেন জগন্নাথপুর, শাল্লা, বালাগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দারা। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে তারা। কবে নাগাদ বিদ্যুৎ-সংযোগ চালু হবে, সেটিও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না উপজেলা বিদ্যুৎ বিভাগ। অবস্থায় পানির সাথে লড়াই করা মানুষগুলো অন্ধকারের সাথেও লড়ছেন।
এ অবস্থায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন ও বানভাসি মানুষের ত্রাণ সহায়তা কাল সিলেট এসেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এসময় তিনি অভিযোগ করেছেন, দেশের মানুষ না খেয়ে আছে। আর সরকার পদ্মা সেতু নিয়ে উৎসব করছে।
ফখরুল ছাড়াও কাল হেলিকপ্টারে সুনামগঞ্জ এসেছিলেন সেনা প্রধান, আইজিপি ও র্যাবের মহাপরিচালক। আইজিপি এসেছিলেন সিলেটেও। তারাও আশ^াসের বাণী শুনিয়ে গেছেন। স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছেন। কিন্তু মানুষের মাঝে যে হাহাকার ও দু:স্বপ্ন শুরু হয়েছে তার কি কোন শেষ আছে- সে উত্তর দিতে পারছেন না কেউই। কারণ কয়েকদফা বন্যায় মানুষের সবকিছু ভেসে গেছে। ভেসে গেছে সোনালী ধান, গবাদী পশু, কাপড়-চোপড়, ডেগ-ডেগচীসহ সব। তলিয়ে গেছে সাজানো গোছানো স্বপ্নের বাড়ী।
এদিকে, বন্যার ভয়াবহতার মাঝে পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠান কিন্তু থামছেনা সিলেটেও। শুধু বলা হয়েছে, পরিস্থিতির কারণে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন সিলেটে জাঁকজমকপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠান কিংবা উৎসব হবে না, হবে শুধু আলোচনা। তবে এদিন সিলেটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বড় পর্দায় দেখানো হবে। বিষয়টি জানিয়েছেন সিলেট জেলা প্রশাসক মো. মজিবুর রহমান।