পানি আতঙ্কে নির্ঘুম রাত
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ জুন ২০২২, ৩:০৩:১৪ অপরাহ্ন
২৪ ঘন্টায় সিলেটে ১১০ ও সুনামগঞ্জে ১৯৬ মি:মি বৃষ্টি
স্টাফ রিপোর্টার :
বন্যায় প্রায় বিধ্বস্ত সিলেট। যখনই একটু উন্নতির আভাস মিলেছে, তখনই আবার শুরু হয়েছে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢল। এতে সিলেটের নদীগুলো ফের ফুলে-ফেঁপে উঠছে। পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত পার করেছেন মানুষ।
শেষ ২৪ ঘন্টায় সিলেট জেলায় বৃষ্টি হয়েছে ১১০ মিলিমিটার। আর এ সময়ে সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হয়েছে ১৯৬ মিলিমিটার। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ভারী বৃষ্টিতে সিলেটের সব প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

উপশহর ডি ব্লক মসজিদের সামনের সড়ক। গতকাল বিকেলে তোলা ছবি।
সিলেটে মঙ্গলবার রাতভর ভারী বৃষ্টি হয়। রাত ৯টার দিকে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়, যা গভীর রাত পর্যন্ত চলে। এরপর মধ্যরাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। তবে বুধবার সকালের দিকে ক্ষণিকের জন্য আকাশে উঁকি দিয়েছে সূর্য। রাতের বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বিভিন্ন সড়ক প্লাবিত হয়ে যায়। ঘরে পানি উঠার শঙ্কায় অসংখ্য বাসা-বাড়ীতে মালামাল সরানোর তোড়জোড় পড়ে যায়। সকালে বৃষ্টি কমার সঙ্গে বিভিন্ন সড়কের পানি নেমে গেলেও বেশ কিছু এলাকা ও সড়ক জলমগ্ন দেখা যায়। নির্ঘুম রাত পার করে অনেকে পত্রিকা অফিসে ফোন করে আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য জানতে চান।
বুধবার সকালে নগরের বিভিন্ন এলাকা ও সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, নগরের তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, লালা দিঘীর পাড় ও শেখঘাট এলাকায় সড়ক-মহল্লায় পানি জমেছে। সেসব এলাকার মানুষের মধ্যে পানি বৃদ্ধি নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবার বন্যার শঙ্কায় অনেকে বাসাবাড়ির মালামাল উঁচু স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। নগরের তালতলা এলাকার খাল থেকে ময়লা-আবর্জনা পরিচ্ছন্ন করতে দেখা গেছে সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের।
নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা ময়নুল বলেন, ‘দুই দফার বন্যায় হঠাৎই ঘরে পানি ঢুকে বেশ কিছু মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এবার বৃষ্টি দেখে আগেই নতুন করে কেনা মালামাল সরিয়ে নিয়েছি। ঘরের ভেতরে ইট বিছিয়ে উঁচু স্থানে তুলে রেখেছি।’ ‘পীর মহল্লা এলাকার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন সানজু বলেন, ঘরে গলা সমান পানি উঠেছে ২ সপ্তাহও হয়নি। ঘরের সব জিনিসপত্র ফেলে নতুন মালামাল কিনতে হয়েছে। এখন আবার ঘরে পানি উঠার উপক্রম হয়েছে। আমরা কি করব, কোথায় যাব-কিছুই মাথায় আসছেনা।
শুধু সিলেট নগর নয়, বিভিন্ন উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন ভারী বৃষ্টি দেখে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘর-বাড়ী ছাড়েন। অনেকে পানি উঠার শঙ্কায় রাত জেগে পাহারা দেন।
সিলেটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিধিরা জানান, ‘মঙ্গলবার আতঙ্কে মানুষজন ঘুমাতে পারেনি। জেগে রাত কাটিয়েছেন। রাতে রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। ঘর-বাড়িতেও পানি উঠা শুরু হয়।
জালালপুরের বাসিন্দা ময়জুল হক বলেন, ‘টানা ৮ থেকে ১০ দিন পর ঘর থেকে পানি নেমেছে। এখন আবার ঘরে পানি উঠলে দুর্ভোগের কোনো সীমা থাকবে না।’ বালাগঞ্জের গৌরীপুর গ্রামের বাসিন্দা সুরুজ আলী বলেন, ‘বারবার এভাবে পানি ঢুকে পড়ছে গ্রামে। আমরা কী করব, কোথায় যাব কিছুই বুঝতে পারছি না।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা বলেন, ‘সিলেটের পাশাপাশি উজানেও বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে নদ-নদীর পানি বাড়ছে। সব জলাধার পানিতে টইটুম্বুর থাকায় নদী পানি টানতে পারছে না। ফলে বৃষ্টির পানি নামার জায়গা পাচ্ছে না’।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমা ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার । ওই পয়েন্টে বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় ১৩ দশমিক ৫৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে বিপদসীমা ১০ দশমিক সেন্টিমিটার। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় ওই পয়েন্টে ১০ দশমিক ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আগের দিনের তুলনায় পানি বেড়েছে দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার।
কুশিয়ারা নদীর আমলশিদ পয়েন্টে বিপদসীমা ১৫ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার। ওই পয়েন্টে বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় ১৬ দশমিক ৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারার ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় ১০ দশমিক ৪৮ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হয়। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায়ও তা অপরিবর্তিত আছে। লোভা নদীর পানি লোভাছড়া পয়েন্টে মঙ্গলবারের তুলনায় বুধবার পানি দশমিক ৩৩ সেন্টিমিটার বেড়ে ১৩ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া সারি নদের পানি সারিঘাট পয়েন্টে মঙ্গলবারের তুলনায় বুধবার বেড়েছে দশমিক শূন্য ৬ সেন্টিমিটার।
এদিকে, সুনামগঞ্জে মাঝখানে এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে সোমবার থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে সুনামগঞ্জে উজানে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হওয়ায় নামছে পাহাড়ি ঢল। এতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে মানুষের মধ্যে। দুই দিনে সুরমা নদীর পানি ২২ সেন্টিমিটার বেড়েছে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মকর্তারা বলছেন, উজানে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই ঢল নামছে। আবার একই সঙ্গে সুনামগঞ্জেও বৃষ্টি হওয়ায় পানি কিছুটা বাড়ছে। তবে বন্যা পরিস্থিতি আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অবনতি হবে, এমন কোনো পূর্বাভাস নেই।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপরে আছে। ২৪ ঘণ্টায় এখানে ২৩ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। দিরাই উপজেলায় পুরাতন সুরমা নদীর পানি আছে বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপরে।
বুধবার সকাল নয়টা সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পাশে সুরমা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৬৬ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার একই সময়ে পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১১ সেন্টিমিটার। সোমবার সকালে পানি উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। এই হিসাবে দুই দিনে পানি বেড়েছে ২২ সেন্টিমিটার। সুরমা ছাড়াও যাদুকাটা, চিলাই, খাসিয়ামারা, চেলাসহ জেলার বিভিন্ন নদী-নদীর পানি আবার বাড়ছে।
সিলেট অঞ্চলের মানুষ ভয়াবহ বন্যাতে এমনিতেই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে কোনোমতে প্রাণে বাঁচেন লাখ লাখ মানুষ। এখনো ঘর-বাড়ীহীন লাখো মানুষ। আশ্রয় কেন্দ্র ও সড়কের পাশে তাবু বাস করছেন সুনামগঞ্জের প্রায় সব এলাকার মানুষ। সিলেটের বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষও এখনো ৮০ ভাগ পানিবন্দি। এ অবস্থায় গত ২ দিন ধরে ফের ভারী বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কেবলই অন্ধকার দেখছেন এ অঞ্চলের মানুষ।