সিলেট-সুনামগঞ্জে নিরব কান্না
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২২, ৩:০১:৪৮ অপরাহ্ন
# ধীরে কমছে পানি, ভেসে উঠছে ধ্বংসচিহ্ন
# ১৫ দিন পর রৌদ্রজ্জ্বল দিন
জালালাবাদ রিপোর্ট :
১৫ দিনেরও বেশী সময় ধরে একটি পূর্ণ রৌদ্রজ্জ্বল দিন দেখায় প্রতিক্ষায় ছিলেন সিলেটের লাখ লাখ মানুষ। অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনের দেখা মিললো। শনিবার সাতসকাল থেকে গোধূলী বেলা পর্যন্ত সিলেটের আকাশে ছিলো ঝলমলে রোদ। এতে সিলেটজুড়ে স্বস্তির হাওয়া বইছে। কিন্তু স্বস্তির পেছনে এখনো রয়ে গেছে দুর্ভোগ, ভোগান্তি ও কষ্টের দিন। কারণ পানি কমছে ধীরে। আর যেসব জায়গা বা ঘর ভেসে উঠছে, কেবলই দেখা যাচ্ছে ধ্বংসের চিহ্ন।
নিজের ঘর-বাড়ীর ধ্বংসলীলার চিত্র দেখে সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষের মাঝে চলছে বোবাকান্না। সিলেটের বন্যা নিয়ে লিখতে এক গবেষকের লেখায় উঠে এসেছে মানুষের করুণ আহাজারী ও নিরব কান্নার চিত্র। তিনি লিখেছেন, ‘সত্তরে ভোলার মনপুরায় মানুষকে কাঁদতে দেখেছিলাম। ৫২ বছর পর আবার সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষকে কাঁদতে দেখলাম। সন্দ্বীপের উড়ির চরে ১৯৮৫ সালে জলোচ্ছ্বাস, অষ্ট আশির বন্যা, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার টর্নেডো, টাঙ্গাইলের মিরিখপুরে ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলা, চৌহালীর নদীভাঙন-যেখানেই গিয়েছি; মানুষের মধ্যে, পাড়ার মধ্যে, সমাজের মধ্যে মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তায় মগ্ন দেখেছি, কিন্তু কাঁদতে দেখিনি। চরম কষ্টের মধ্যে মানুষ বেজার না হয়ে হাসিমুখে কথা বলেছে, প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। কিন্তু এবার সিলেটের মানুষ যেন বোবা হয়ে গেছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যায় মানুষ ভেসে যায়নি, কিন্তু তাঁদের সব স্বপ্ন ভেসে গেছে। সাজানো ঘরবাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, কাঁথা-বালিশ, কাপড়চোপড়, গবাদি পশু, সারা বছরের খোরাকী ধান-চাল সব ভেসে গেছে। হাজার হাজার মানুষের পরনের কাপড় ছাড়া আর কোনো কাপড় নেই। তাই গোসল নেই।’
এদিকে, রৌদ্রজ্জ্বল দিনে যেসব ঘর-বাড়ী ভেসে উঠছে, তাতে কেবলই ধ্বংসের চিহ্ন ভেসে উঠতে দেখা গেছে। শনিবার এমনই একটি চিত্র সামনে এলো সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদের শাখা জাহাজখালী নদী। এর পাড় ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিম বুড়দেও গ্রাম। এ গ্রামেই বাস আখতারুজ্জামান-মুর্শিদা খাতুন দম্পতির। ১৫ জুন এক রাতের ব্যবধানে বন্যায় তাঁদের ঘরে গলাসমান পানি হয়ে যায়। তখন এক কাপড়ে পরিবারের সদস্যরা বের হয়ে যান। আখতারুজ্জামান-মুর্শিদারা ভিটা ভেসে উঠার পর ঘরে ফিরে দেখেন, তাঁদের পুরো ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে এক পাশের বেড়া। ভেসে গেছে ফ্রিজ, আসবাব, হাঁড়িপাতিল, চাল-ডাল। এসব হারিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন তাঁরা।
মুর্শিদা খাতুন জানান, শাশুড়ি, স্বামী এবং দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। বন্যায় সন্তানদের বইপুস্তকও ভেসে গেছে, ভিজে নষ্ট হয়েছে।
মুর্শিদা বলেন, ‘ঘরে খাবারদাবারই নেই, আর ঘর ঠিক করা তো দূরের কথা। এই ভাঙা ঘর ঠিক করার সামর্থ্য আমাদের নেই। স্বামী গার্মেন্টসশ্রমিক। সঞ্চয় বলতেও আমাদের কিছু নেই। উপজেলা সদরের পাশে আমাদের গ্রামের অবস্থান হওয়ায় সচ্ছল ভেবে কেউ ত্রাণও দেয়নি। অথচ এখন না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা আমাদের।’
শুধু আখতারুজ্জামান-মুর্শিদা দম্পতিই নয়, ভেসে উঠার পর নিজ বসত ভিটায় ফিরে অনেকেই দেখছেন বন্যার করাল গ্রাসে কেমন দুমড়েমুচড়ে গেছে তাদের স্মৃতি-বিস্তৃতির ঘর-বাড়ী।
এদিকে, সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সিলেটের দুটি নদীর পানি চারটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও পানি কমছে। নদীর কোনো কোনো পয়েন্টে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৯টার ব্যবধানে দশমিক ২০ সেন্টিমিটার থেকে দশমিক শূন্য ২ সেন্টিমিটার কমেছে।
তবে শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি অমলশিদ, শেওলা, কুশিয়ারা পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শুক্রবার সন্ধ্যার তুলনায় শনিবার সকাল ৯টায় দশমিক ১০ সেন্টিমিটার কমে ১৩ দশমিক ২৪ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। নদীর সিলেট পয়েন্টে শুক্রবার সন্ধ্যার তুলনায় শনিবার সকাল ৯টায় দশমিক শূন্য ৭ সেন্টিমিটার কমে ১০ দশমিক ৬৬ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে পানি শুক্রবারের তুলনায় শনিবার দশমিক ১৬ সেন্টিমিটার কমেছে। শেওলা পয়েন্টে পানি দশমিক শূন্য ৫ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে দশমিক শূন্য ২ সেন্টিমিটার কমেছে।
সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় নদ-নদীর পানি কমছে, তবে অনেকটা ধীরগতিতে। আশা করা যাচ্ছে, আরও কয়েক দিন বৃষ্টি না হলে পানি আরও কমবে। তিনি বলেন, সিলেটে আগামী ১০ দিনের মধ্যে বন্যার আগাম কোনো সতর্কতা নেই।
এদিকে, সিলেট নগরে পানি কমলেও ভেসে উঠছে ময়লা-আবর্জনা। শনিবার সকাল থেকে নগরের শাহজালাল উপশহর, মাছুদিঘির পাড়, মির্জাজাঙ্গাল ও তেররতন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানি নেমে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন বাড়িঘর ধোয়ামোছার কাজ শুরু করছেন। তবে দীর্ঘদিন পানি জমে অনেকের আসবাব, কাপড়চোপড় ও বিছানার তোশক নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে পানি নেমে গেলেও বিভিন্ন বাসাবাড়ির সামনে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মহল্লার সড়কগুলো এখনো পানির নিচে।
নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার এ ব্লকের খালে পলিথিন, প্লাস্টিকের বস্তা, গাছের পাতাসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা জমে থাকতে দেখা গেছে। ময়লা-আবর্জনার কারণে খালের পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। এসব আবর্জনা জমে থাকায় পানি কালো রং ধারণ করেছে। এ ছাড়া শাহজালাল উপশহরের সি, ডি, জে ব্লক ও তেররতন এলাকার মহল্লায় একই চিত্র দেখা গেছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে ময়লা-আবর্জনা ভেসে এসেছে। তবে পানি কমে আসার পর সেগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে।