সিলেটে ঘন ঘন বন্যা নিয়ে ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠক: দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে পদক্ষেপ জরুরী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০২২, ৮:৩০:২৭ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা : সিলেট অঞ্চল বার বার বন্যা কবলিত হচ্ছে। এই অস্বাভাবিক বন্যার কারণ ও সমাধান অনুসন্ধানের জন্য ঢাকায় একটি গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সিলেট অঞ্চলে ঘন-ঘন বন্যা : কারণ, পুনর্বাসন ও স্থায়ী সমাধান’ শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ।
সিলেট বিভাগ সাংবাদিক সমিতি (সিবিসাস) ঢাকা এর আয়োজনে ও অল ইউরোপিয়ান বাংলা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিবিসাসের সভাপতি আজিজুল পারভেজ এবং ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন আয়োজক কমিটির আহবায়ক এহসানুল হক জসীম।
প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম।
পানি, নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন পদ্মা সেতু প্রকল্প বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ও বুয়েটের সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও ডিন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মতীন উদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইপিডির পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম, রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি সৈয়দ জগলুল পাশা ও প্রতিদিনের বাংলাদেশ সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি।
সিবিসাসের পক্ষ থেকে সাত-দফা সুপারিশ তুলে ধরেন এহসানুল হক জসীম। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জকে দুই মাসের জন্য বন্যা-দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে বন্যায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তার স্থায়ী সমাধানে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া।
সভায় বক্তারা বলেন, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন, প্রবাসী ও হৃদয়বান ব্যক্তিদের চলমান ত্রাণ কার্যক্রম প্রশংসনীয়। অনেকের বাড়িঘর সম্পুর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত, কারো আংশিক। ফের ঘর মেরামত করা কিংবা পুরো নষ্ট হওয়ায় গৃহ নির্মাণ করে নিজ ভিটায় ফেরার সামর্থ্য হারিয়েছেন অনেকে। এই অবস্থায় পুনর্বাসন প্রয়োজন। খাদ্য সামগ্রী বিতরণের চাইতে ঘরে ফেরানো বা ভাঙা গৃহে ফেরাদের গৃহ নির্মাণের দিকটির উপর নজর দেওয়া বেশি প্রয়োজনীয়।
তারা আরো বলেন, বন্যা যেসব কারণে হয়েছে, তা চিহ্নিত করে দ্রুত ও স্থাায়ী সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য। স্থায়ী সমাধানে মনোযোগ দিতে হবে। এই কাজে স্থানীয় অংশীজন এবং দেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, হাওর অঞ্চলে বিগত ২৫ বছরে যে পরিমাণ সক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে এই ধরনের বন্যায় শতকরা এক ভাগ লোকসান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তা, এমন কোনো রাস্তা নেই যার ক্ষতি হয়নি। বন্যার তুলনায় প্রাণহানি কম হয়েছে, তবে আমি কিন্তু বন্যা হোক সেটা চাচ্ছি না। তাই বলে আমরা কি হাওর অঞ্চলে উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে দিব।
মন্ত্রী বলেন, অতি শিগগিরই স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সার্ভেয়ার তৈরি করে বন্যা কবলিত এলাকায় পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হবে। বন্যা আর হবে না বলছি না, বন্যা হবে এটা মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন বন্যা কবলিত এলাকায় আগে ত্রাণ পরবর্তীতে নির্মাণ। যদিও কোথাও কোথাও ত্রাণ চাচ্ছে না, ক্যাশ টাকা চাচ্ছে।
ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে শীঘ্রই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। বাড়িঘর নির্মাণের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বন্যা প্রতিরোধে দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর, বিলসহ অন্যান্য জলাশয় খননে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন শাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, জলাশয়সম‚হের পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে বন্যার তীব্রতা কমানো সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমাতে পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। অবাধে বৃক্ষ নিধন, পাহাড়, টিলা কর্তন বন্ধ করতে হবে। পরিবেশমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সুরমা ও কুশিয়ারার নদীপথ পুনরায় চালু করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারের বিশেষ উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। যেকোনো দুর্যোগে অসহায় মানুষের সহযোগিতায় সমাজের সামর্থ্যবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান মন্ত্রী ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, এবারের বন্যায় সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। বলা যেতে পারে, যে প্রস্তুতি ছিল তা আপ টু মার্ক ছিল না। তবে এতে সরকারকে যে পুরোপুরি দোষারোপ করা যাবে তা কিন্তু না। কারণ এবার যে এমন বন্যা হবে তা ছিল অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, এখন যারা ত্রাণ বিতরণের জন্য অর্থ সাহায্য করছেন, তা জমিয়ে রাখুন। সরকারে পুনর্বাসন কর্মকাণ্ডে সে অর্থ বিনিয়োগ করুন।
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, আমাদের ২৫টি আন্তঃসীমান্ত নদীর তথ্য শুধু রয়েছে। আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলেছি, আমাদের ৫৪টি নদীর তথ্যই লাগবে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে সিলেটে। সিলেটে ১২০ কোটি ৮১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, সুনামগঞ্জে ১৯১ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা, মৌলভীবাজারে ৯৯৬ কোটি টাকা, হবিগঞ্জে ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে।
শরীফ জামিল বলেন, যে কোন উন্নয়নকাজে পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে উন্নয়ন দর্শন পাল্টিয়ে অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্ধ করা জরুরি। উন্নয়ন হবে; তবে পরিবেশ-প্রতিবেশকে ধ্বংস করে নয়।
অধ্যাপক ড. কাজী মতীন উদ্দীন আহমেদ বলেন, পানি ব্যবস্থাপনায় পাশর্^বর্তী দেশগুলোর সাথে আরো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনগণের মধ্যে আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে যথাসময়ে সতর্কবার্তা পৌছানো এবং আরো সচেতনতা তৈরী করার জোর দেন।
হাওর এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়, তা বন্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হয় বলে আলোচানয় উল্লেখ করেন মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বলেন, মেঘনা অববাহিকায় ভারতের আন্তঃসীমা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আমাদের কূটনীতিক দুর্বলতা রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪ টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তা নিয়ে সঠিক তথ্য উপাত্ত আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাই না। যাই হোক, আমরা মনে করি, এই ইস্যুতে যৌথ নদী কমিশনকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে।