পাথর উত্তোলনে চাপ কমবে রিজার্ভে
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুলাই ২০২২, ১২:০১:৫১ অপরাহ্ন
এম.এ জলিল, কোম্পানীগঞ্জ :
দেশের চলমান উন্নয়ন ও বড় বড় প্রকল্পগুলোর প্রধান উপকরণ হচ্ছে পাথর। নির্মাণাধীন সড়ক-মহাসড়ক বাসাবাড়ি কিংবা বড় প্রকল্প সব জায়গায় পাথর অপরিহার্য। দেশের পাথর খনিগুলো বন্ধ থাকায় আমদানি করতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। ইটের খোয়া থেকে পাথরের গুণগত মান ভালো থাকায় বেড়েছে এর আমদানির পরিমাণ। আমদানিতে যুক্ত হয়েছে দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী। দশকের ঘর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে সহস্র কোটি টাকার ঘরে উত্তীর্ণ হয়েছে পাথর আমদানির পরিমাণ। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাথর আমদানি। পণ্যভিত্তিক আমদানির প্রবৃদ্ধির হিসেবে পাথর উঠে এসেছে শীর্ষে। বিদেশ থেকে পাথর আমদানির কারণে কোটি কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এর ফলে চাপ পড়ছে বৈদেশিক রিজার্ভের উপর। বৃদ্ধি পাচ্ছে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম। কিন্তু দেশের বড় বড় খনি থেকে পাথর উত্তোলন করতে পারলে আমদানির পরিমান কমে আসত। চাপ কমত রিজার্ভের উপর থেকে। ব্যয় কমে আসত বড় বড় প্রকল্পসমূহের।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, শ্রীপুরসহ প্রায় ১০-১২ টি পাথর খনি রয়েছে। যেখান থেকে দেশের চাহিদা মেটাতে ১ কোটি টন পাথর উত্তোলন করা সম্ভব। বৈদেশিক রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে দেশের এই সকল পাথর খনি থেকে পাথর সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে।
গত ৩১ মে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাথর কোয়ারি, পাথর উত্তোলন, খাস আদায় ও জব্দকৃত পাথর উন্মুক্ত নিলামের বিষয়ে দায়েরকৃত মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সভায় গেজেটভূক্ত পাথর কোয়ারি সমূহ পূনরায় ইজারা প্রদানে যোগ্য কি না তা যাচাই করার লক্ষ্যে জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভে এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সমূহের ১০ জন প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারা মজুদ পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনযোগ্য পাথরের পরিমাণ, উত্তোলনের সময়কাল, পাথর কোয়ারি এলাকার পরিবেশ, পর্যটন শিল্পের বিকাশ বিবেচনা করে পাথর কোয়ারি সমূহের হালনাগাদ করবেন। এছাড়াও খনি ও খনিজ সম্পদ আইন ১৯৯২ এবং খনি ও খনিজ সম্পদ বিধিমালা ২০১২ পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক সংশোধনের প্রয়োজন হলে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়ন করতেও বলা হয়েছে এই কমিটিকে।
সুত্রে জানা যায়, ভোলাগঞ্জ পাথর খনি চালু অবস্থায় প্রতিদিন প্রায় ৩ লক্ষ ফিট পাথর সংগ্রহ করা সম্ভব হতো। সে সময়ে সরকারি হিসাবে ৪৮ টাকা দরে ১ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকার পাথর সংগ্রহ হতো। তবে বেসরকারিভাবে এই আস্ত পাথর বিক্রি হতো ৮০-৮৫ টাকায়।
পরিবেশ বিপর্যয়ের দোহাই দিয়ে দেশের পাথর খনি বন্ধ করে আবার বিদেশের পাহাড় কেটে আমদানি হচ্ছে পাথর। বর্তমানে দেশের পাথরের চাহিদার বেশিরভাগ অংশ যোগান দিচ্ছে ভারত। তাদের কাছ থেকে ৫০ শতাংশ পাথর আমদানি করছে বাংলাদেশ। এর বাহিরে রয়েছে দুবাই, ভিয়েতনাম ও ভুটান।
২০১৬ সালের আগে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ছয়টি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত ও ভুটান থেকে পাথর আমদানি করতেন। এ সময় বছরে পাথর আসত মাত্র ৬০ কোটি টাকার। যখন পাথরের বাজার বড় হতে শুরু করে, তখন জড়িয়ে যায় বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী। গত তিন বছর থেকে তারা পাথর আমদানিতে যুক্ত হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপ অন্যতম। সাগর ও নদীপথে নিজেদের জাহাজ ব্যবহার করে বিদেশ থেকে সরাসরি পাথর নিয়ে আসছে তারা। এই গ্রুপগুলো যুক্ত হওয়ার পর গত ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে পাথর আমদানি হয়েছে ২ কোটি ৪৮ লাখ টন। যার বাজার মূল্য ৯ হাজার কোটি টাকা। তাতেই পণ্যভিত্তিক আমদানির প্রবৃদ্ধি বা বাজারের আকার হিসেবে পাথর উঠে এসেছে শীর্ষে। তাই পাথরের আমদানি নির্ভরতা ও খরচ কমাতে দেশীয় খনি থেকেই পাথর সংগ্রহে নজর দেয়া জরুরি। এটি করা হলে, পাথর ক্রয়ে খরচ কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। এরপর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েই তিনটি অগ্রাধিকারের কথা বলেছেন আবদুর রউফ তালুকদার। এর মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ধরে রাখার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে চান। এদিকে পাথরের পরিবহন খরচ গত এক বছরে দ্বিগুণ বেড়েছে জানিয়ে আমদানিকারকরা সারাদেশে বাস্তবায়িত বড় প্রকল্পগুলোর স্বার্থে পাথর আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তারা জানান, প্রতি টন বিল্ডিং সামগ্রীর জন্য কাস্টমস ডিউটি, পোর্ট ডিউটি, ভ্যাট, এসডি এবং এআইটি হিসেবে প্রায় দেড় হাজার টাকা দিতে হয়। এ খাতকে শক্তিশালী করতে শুল্ক কমানো উচিত বলে মনে করেন তারা। বৈদেশিক রিজার্ভের বর্তমান অবস্থায় শুল্ক কমিয়ে দিলে দেশ অর্থনৈতিক চাপে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে দেশীয় খনি চালু হলে বিদেশ থেকে পাথর আমদানি কমে যাবে। সাশ্রয় হবে ডলারের। মান বাড়বে টাকার।
বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল জলিল মেম্বার বলেন, বিদেশ থেকে পাথর আমদানি করার কারণে পাথরের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ছে। দেশীয় খনি থেকে পাথর সংগ্রহ করলে পাথরের দাম প্রায় ৫০ টাকা পর্যন্ত কমে আসবে। এতে রিজার্ভের উপর চাপ কমার পাশাপাশি সহজলভ্য হবে পাথর। এছাড়া পাথর ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ, গাড়ি কিস্তি দিতে না পারায় দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
ভোলাগঞ্জ চুনা পাথর আমদানীকারক গ্রুপের সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, দেশের খনি থেকে পাথর সংগ্রহ হলে বিপুল পরিমাণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। এ ক্ষেত্রে আগে চাঁদাবাজদের দূর করতে হবে। কারণ চাঁদাবাজদের জন্য সরকার সঠিক রাজস্ব পায়না। আর ভোলাগঞ্জ শুল্কস্টেশন দিয়ে যে চুনা পাথর আমদানি হয় তা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দেশীয় খনির পাথরের সাথে আমাদের আমদানিকৃত পাথরের মিল নেই। দেশের খনি থেকে পাথর সংগ্রহ হলে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশও লাভবান হবে।