লোডশেডিংয়ে শিডিউল বিপর্যয় অব্যাহত
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ জুলাই ২০২২, ১২:৩০:১১ অপরাহ্ন
* চাহিদা ২২০, সরবরাহ ১০৪ মেগাওয়াট *গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ যায়না, মাঝে মাঝে আসে
এমজেএইচ জামিল : জ্বালানী সাশ্রয়ে সারাদেশে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের রুটিন (সময়সূচী) ঘোষণা দিয়েও তা রাখতে পারছেনা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানীগুলো। দিন দিন উৎপাদনের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় রুটিনের (সূচি) বাইরেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সিলেটে ছিল সরকারের পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের ৩য় দিন। এ দিন সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় ৩ থেকে ৪ বার ১ ঘন্টা করে লোডশেডিং করা হবে বলা হলেও ৪ থেকে ৫ বার টানা দেড় থেকে ২ ঘন্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করা হয়েছে।
শিডিউল ঠিক রাখতে না পারার জন্য চাহিদার বিপরীতে কম বিদ্যুৎ সরবরাহকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে একদিনের ব্যবধানে জাতীয় গ্রীড থেকে সিলেট বিভাগ ৫% বিদ্যুৎ কম পেয়েছে। ফলে বুধবার থেকে সিলেটে বৃহস্পতিবার লোডশেডিং বেশী করতে হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সিলেট বিভাগে বিদ্যুতে পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ মিলে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। এর বিপরীতে জাতীয় গ্রীড থেকে সিলেট বিভাগে সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ১০৪ মেগাওয়াট। এরমধ্যে পল্লী বিদ্যুৎ পায় মাত্র সাড়ে ১২ মেগাওয়াট। বাকীটা ছিল পিডিবি’র। যা চাহিদার বিপরীতে ৬০%। অথচ এর আগেরদিন সিলেট সরবরাহ পেয়েছিল চাহিদার ৬৫%। ফলে বাধ্য হয়েই লোডশেডিং বাড়াতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা।
একদিকে গরমে সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা অন্যদিকে ক্ষণে ক্ষণে লোডশেডিং। দুবির্ষহ অবস্থায় রয়েছেন সিলেটের মানুষ। বিদ্যুৎ বিভাগের দেয়া শিডিউলের এর সাথে মিলছে না লোডশেডিং। কোনো এলাকায় ৩ থেকে ৪ বার লোডশেডিং করা হবে বলা হলেও ৫ থেকে ৬ বারও লোডশেডিং করা হচ্ছে। ১ ঘন্টা করে লোডশেডিং করার কথা থাকলেও অনেক সময় দেড় থেকে ২ ঘন্টা হচ্ছে লোডশেডিং।
সূত্র জানায়, আগাম বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলায় সরকার ১৯ জুলাই থেকে সারাদেশে লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর করে। সে সময় বলা হয়েছিল সর্বোচ্চ দু ঘন্টা করে লোডশেডিং করা হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সিলেট অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিপনন ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা বিপিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ আলাদাভাবে লোডশেডিংয়ের শিডিউল প্রকাশ করে। শিডিউলে প্রতিটি ফিডারের নাম উল্লেখসহ কখন এবং কতক্ষণ বিদ্যুৎ থাকবে না তা জানানো হয়। বাস্তবে দেখা গেছে, শিডিউলের সাথে লোডশেডিংয়ের কোনো মিল নেই। ৩ বার লোডশেডিংয়ের শিডিউল দেয়া হলেও দিনের মধ্যে ৪ থেকে ৬ বার লোডশেডিং হচ্ছে।
সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বৃহষ্পতিবার বিদ্যুৎ গেছে ৪ থেকে ৫ বার। এদিকে রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ রাখার সরকারী সিদ্ধান্তে বিপাকে ব্যবসায়ীরা। এরমধ্যে দিনে ৪ বার লোডশেডিংয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যে ধ্বস নেমেছে। ব্যবসায়ীরা জানান গরমে বেচাকেনার অবস্থা এমনিতেই খারাপ। তার উপর রাত ৮ টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করতে হচ্ছে। শুরুতেই আমরা ব্যবসায় বড় একটি ধাক্কা খাচ্ছি। বন্দরবাজারের ফটোকপির দোকানদার বলেন, বিদ্যুৎ না থাকলে আমাদের ব্যবসা হয় না। বারবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় আমরা খুব সমস্যায় রয়েছি। একজন স্কুল শিক্ষক জানান, ১৯ জুলাই বিকালে লোডশেডিং করার কথা, লোডশেডিং শুরু হয়েছে সকালে। বিদ্যুৎ আসে আর যায়। সরকারি অফিস আদালত, স্কুলের সময় কমিয়ে দেয়া হোক, ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণ করা হোক-লোডশেডিংয়ের কোনো প্রয়োজন হবে না।
জানাগেছে, শহরে দেড় থেকে ২ ঘন্টা লোডশেডিং হলেও টানা ৩ থেকে ৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ মিলছে। সবচেয়ে করুণ অবস্থা গ্রামাঞ্চলে। মহানগর জেলা, পৌরসভা ও উপজেলা শহরগুলোতে সরবরাহ কিছুটা ভালো রেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে চলছে মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং। সেসব এলাকায়ও লোডশেডিংয়ের শিডিউল দেয়া হয়েছে। ঘোষিত শিডিউলে ১ ঘন্টা করে ৫ থেকে ৬ বার লোডশেডিংয়ের কথা থাকলেও দিনে রাতে গড়ে ৪ থেকে ৫ ঘন্টাও থাকছেনা বিদ্যুৎ। এমনকি সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১২টার আগে চলছে টানা লোডশেডিং। এছাড়া একটু বৃষ্টি কিংবা আকাশে বিজলী চমকালো একেবারেই হাওয়া হয়ে যায় বিদ্যুৎ। গ্রামাঞ্চলে পল্লী বিদ্যুতের সরবরাহ কিছুটা উন্নত হলেও পিডিবির বিদ্যুৎ বিতরণ গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের মানুষ আক্ষেপ করে বলেন, এখানে বিদ্যুৎ যায় না, মাঝে মাঝে আসে।
সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের চরম বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যঘাত ঘটছে। পাশাপাশি তীব্র গরমে বয়স্ক ও শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় অতিরিক্ত ঘামের ফলে শিশুরা বুকে ঠাণ্ডা লেগে সর্দি জ¦রের পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। শহরের ন্যায় গ্রামীণ জনপদেও চার্জার লাইট, চার্জার ফ্যান কেনার হিড়িক পড়েছে। পাশাপাশি সৌরবিদ্যুত সংযোগের জন্য অনেকে যোগাযোগ শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদী লোডশেডিং থেকে রক্ষায় শহরের ন্যয় প্রস্তুতি নিচ্ছে গ্রামের মানুষ।
সুনামগঞ্জ জেলা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মশিউর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বৃহস্পতিবার আমার আওতাধীন সুনামগঞ্জ শহরের ৬টি ফিডারের এলাকায় ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পেয়েছি ৬ মেগাওয়াট। ফলে আমাকে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সরবরাহ যথেষ্ট না পেলে শিডিউল ঠিক রাখা সম্ভব নয়। এরপরও আমরা চেষ্টা করি সব এলাকায় যাতে সুষম বন্টন হয়। প্রতিদিনই সরবরাহ কমছে ফলে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। সরবরাহ বাড়লে লোডশেডিং কম হবে।
সিলেট বিভাগীয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. জারজিসুর রহমান রনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের সমন্বয়ের আলোকে লোডশেডিং এর শিডিউল তৈরি করা হয়েছে। তবে লোডশেডিং নির্ভর করে আমরা জাতীয় গ্রীড থেকে কোন সময় কতটা বিদ্যুৎ পাচ্ছি তার উপরে। অর্থাৎ যখন প্রয়োজনীয় পরিমানে বিদ্যুৎ পাই, তখন আমরা লোডশেডিং করি না, ঘাটতি হলে করি। কখন ঘাটতি হবে, তা আগে থেকে বলা সম্ভব হয় না। এ জন্য শিডিউল পুরোপুরি অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো জানান, বৃহস্পতিবার সিলেট অঞ্চলে ১১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল। লোডশেডিংও সেভাবে করা হয়েছে। ঘাটতি বেশি হলে লোডশেডিং বেশি হবে। বৃহস্পতিবার সিলেটে পিডিবির চাহিদা ছিল ১৯৫ মেগাওয়াট ও পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ২৫ মেগাওয়াট। এরমধ্যে পিডিবি সরবরাহ পেয়েছে ৯২ মেগাওয়াট ও পল্লী বিদ্যুৎ পেয়েছে মাত্র সাড়ে ১২ মেগাওয়াট। চাহিদার বিপরীতে ৪০% বিদ্যুতের ঘাটতি থাকলে লোডশেডিং কমানো যাবেনা। একদিনের ব্যবধানে সরবরাহ কমেছে। শুক্রবার জাতীয় গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমবে না বাড়বে এর ভিত্তি করে লোডশেডিং করা হবে।