হাওর-নদীর সিলেটেও মাছের ঘাটতি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুলাই ২০২২, ৩:০১:০৭ অপরাহ্ন
আহবাব মোস্তফা খান :
গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর সবুজ ফসলে পূর্ণ মাঠ সিলেটের এক চিরন্তন ছবি। অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, অন্তহীন হাওড়-বাঁওড় ও পুকুরে সমৃদ্ধ সিলেট। অথচ এই সিলেটেই চাহিদার বিপরীতে রয়েছে মাছের ঘাটতি। জেলার মৎস্যখাত পার করছে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। যা ভাবাচ্ছে খোদ মৎস্য কর্মকর্তাদের।
সিলেট মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সিলেট জেলায় ঘাটতি ছিলো ২ হাজার ৬৯২ মে.টন মাছ। ৭৮ হাজার ১২০ মে.টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৭৫ হাজার ৪২৭ মে.টন। উৎপাদনের মাত্র ৩১ শতাংশ আহরিত হয় চাষ থেকে, আর ৬৯ শতাংশ হাওর-বিল থেকে। এ বছর বন্যায় হাজারো খামার ভেসে গেছে। ফলে এ অর্থবছরে উৎপাদন নজিরবিহীন হ্রাস পাবে ও ধ্বস নামবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেট জেলায় মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, এটা খুবই এলার্মিং। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সিলেটে মাছের নির্দিষ্ট গভীরতা হারিয়ে যাচ্ছে। নদী-নালা, হাওর-বাওর, খাল-বিল সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া জেলায় মাছ উৎপাদনের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অবাধে যত্রতত্র ঘর-বাড়ি নির্মাণ, কীটনাশক ব্যবহার, মাছের অতি আহরণ ও মৎস্য আইন না মেনে প্রজনন মৌসুমে মাছ শিকার। ফলে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছেনা। প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাইরের জেলার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হচ্ছে।
মৎস্য বিভাগ জানায়, সিলেট জেলায় হাওর রয়েছে ৫৫টি, নদী ৩৭টি, বিল-জলমহাল ৬৬৭টি, বাণিজ্যিক মৎস্য খামার ২৭৭টি, প্লাবনভূমি ৪১৬টি ও পুকুর ৫ হাজার ৩৪৮টি। এসব উৎস থেকে মাত্র ৩১ শতাংশ মাছ চাষের মাধ্যমে আহরিত হয়। যা সত্যিই হতাশার ব্যাপার। এর উপর এবারের বন্যায় হাজারো মৎস্য খামার ভেসে যাওয়া মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মৎস্য বিভাগ একটি প্রতিবেদনে সিলেটের মৎস্যখাতের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার চিত্র তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, সিলেটে মৎস্যখাতের অঞ্চলভিত্তিক কোন প্রকল্প নেই। মৎস্য আইন বাস্তবায়নে লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। গুণগত পোনা মাছের নিশ্চয়তাও নেই। মাছ চাষে মানুষের অনাগ্রহ। আকস্মিক বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়ে মাছ চাষে অনিহা।
অন্যদিকে, মৎস্য অফিসগুলো একেবারেই অবহেলিত। অন্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট জেলা ও উপজেলায় জনবল ও যান সংকট প্রবল। ফলে ডোর টু ডোর নক করতে পারছেনা মৎস্য বিভাগ। এছাড়া মৎস্য অফিসগুলোতে সিলেটের লোকাল মানুষ খুবই কম, তাদের চাকুরীরও নিশ্চয়তা নেই। এসব নানান সীমাবদ্ধতার কারণে সিলেট জেলার সম্ভাবনাময় মৎস্য খাত হারিয়ে যাচ্ছে বিস্তৃতির আড়ালে।
মৎস্য অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় উপ পরিচালক মো: আনোয়ার হোসেন বলেন, নানা চ্যালেঞ্জ ও সমস্যায় জর্জরিত সিলেটের মৎস্য খাতে সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করতে হবে। তবেই মৎস্য খাত ঘুরে দাড়াবে। তিনি বলেন, সবকিছুর খরচ বেড়ে গেছে। মাছ চাষেও খরচ বেড়ে গেছে। এজন্য অনেকেই আগ্রহ হারান এ খাতে বিনিয়োগে। এছাড়া এখন আবার বন্যায় ভেসে নিয়ে গেছে হাজারো খামারীর মাছ। ফলে আগামীতে আরো কমার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, মাছের এ ক্ষতিপূরণ একটি কঠিন কাজ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, সিলেটে মাছ চাষ কম এটা খুবই হতাশার বিষয়। অথচ সিলেটের রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা। তিনি জানান, সিলেটের মৎস্য খাতে একদিকে যেমন নদী. পুকুর, জলাশয় ও হাওর ভরাট অন্তরায়। অন্যদিকে সিলেট মৎস্য বিভাগে প্রকট জনবল সংকটও অন্যতম অন্তরায়। তবুও চেষ্টা চলছে ঘুরে দাড়ানোর। তিনি জানান, সরকারও ভাবছে সিলেটের মৎস্য খাত নিয়ে। এজন্য চাষের সময়কাল পরিবর্তন, স্বল্প সময়ে বৃদ্ধি পায়-এ ধরনের মাছ চাষের উদ্বুদ্ধরকরণ নিয়ে মৎস্য বিভাগ কাজ করছে। তিনি বলেন, হাওর-বিলের উৎপাদন ধরে রাখা ও পুকুরে উৎপাদন বৃদ্ধিতে অংশগ্রহনমুলক মনযোগই এ অঞ্চলের মৎস্য উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হতে পারে।
এদিকে, মাঠ পর্যায়ের মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, মাছ একটি পচনশীল পণ্য। আহরণের পরই এর বাজারজাত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু সিলেটের অনুন্নত অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থার কারণে মাছের বাজার দক্ষ নয়। তা ছাড়া বরফ দেয়া, প্রক্রিয়াজাত করা, ক্রমানুসারে সাজানো, হিমায়িত করা ইত্যাদি কাজ সঠিকভাবে করা হয় না বলে ভোক্তার নিকট অনেকসময় গ্রহণযোগ্য তাজা মাছ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয় না।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আহরণ থেকে ভোক্তার নিকট পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ মাছ নষ্ট হয়ে যায়। এক হিসাব মতে মাছের বিপণন খরচ ও মুনাফা ভোক্তা প্রদত্ত মূল্যের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ। এটি বিপণন অদক্ষতারই পরিচায়ক।
বর্ষা মৌসুমে সিলেট অঞ্চলের বিশাল এলাকা থাকে জলমগ্ন। বছরের প্রায় ৭-৮ মাস সেখানে মানবেতর জীবন কাটায় হাওড়ের অসংখ্য মানুষ। সেখানে আধুনিক মৎস্য চাষের সম্ভাবনা প্রচুর। তাছাড়াও হাওড়ের উন্মুক্ত জলাশয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র বিধায় এগুলো সংরক্ষণ করা দরকার।
এদিকে, এসব সমস্যা ও সম্ভানবনার মাঝে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে মৎস্য সপ্তাহ। এ উপলক্ষে সিলেট মৎস্য বিভাগ সপ্তাহব্যাপী নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। গতকাল প্রথম দিনে সিলেটের সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ও করেছে সিলেট জেলা মৎস্য অফিস। এসময় বক্তব্য রাখেন মৎস্য অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় উপ পরিচালক মো: আনোয়ার হোসেন, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আবুল কালাম আজাদ ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো: আরিফ হোসেন।
এসময় জানানো হয়, আজ রোববার দিনের শুরুতে জেলা প্রশাসকের অফিসের সামন হতে অনুষ্ঠিত হবে র্যালী। এরপর বেলা ১০টায় জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এছাড়া চাদনীঘাটে পোনা মাছ অবমুক্তকরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হবে আজ। সপ্তাহব্যাপী আরো অনুষ্ঠান চলবে ২৯ জুলাই পর্যন্ত।