বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের নেপথ্যে রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুলাই ২০২২, ১১:০০:৩৬ অপরাহ্ন
প্রতিদিনই বাড়ছে লোডশেডিং
জালালাবাদ রিপোর্ট: দিন দিন প্রকট হচ্ছে বিদ্যুৎ সঙ্কট। দেশে সর্বত্র বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে জনমনে আতঙ্ক। প্রতিদিনই বাড়ছে লোডশেডিং। ১ ঘন্টার বদলে ৬ থেকে ৭ বার হচ্ছে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা থাকছেনা বিদ্যুৎ। গ্রামে দিনে রাতে গড়ে ৪ থেকে ৬ ঘন্টার বেশী বিদ্যুৎ পাচ্ছেনা মানুষ।
জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানী সঙ্কট সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সেক্টরে বেহাল দশার নেপথ্যে রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল। ভাড়াভিক্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণের মানদণ্ড না থাকায় বিদ্যুৎ না পেলেও শত শত কোটি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এইসব কোম্পানির শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। এছাড়াও পর্যায়ক্রমে রয়েছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি। এর বাইরে দেশ এনার্জি, এনার্জিপ্যাক, ডরিন গ্রুপ, সিনহা গ্রুপ, রিজেন্ট গ্রুপ, আনলিমা গ্রুপ রয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। এসব কোম্পানির বেশির ভাগই সরকারি দলের নেতা, সরকারি দল সমর্থিত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি। গার্মেন্টস ব্যবসা, কাঠের ব্যবসা করেছেন এমন কোম্পানীকে রাজনৈতিক পরিচয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। আর এসব কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ না পেলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দলীয় বিবেচনায় রেন্টাল ও কুইন রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়ে এবং ঐসব কোম্পানিকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার কারণে দেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে বিপর্যয় নেমে আসছে। প্রশ্ন হচ্ছে রেন্টাল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে কার স্বার্থে? এ দিকে আরো ৩ টি কোম্পানিকে এ সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। এব্যাপারে ক্যাবের জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অসামঞ্জস্য। চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যারা চুক্তি করেছেন তাদের সততা ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যথাযথ ভাবে চুক্তি না হওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এখন দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে।
জ্বালানী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বলেন, চলমান লোডশেডিং জ্বালানী সাশ্রয়ের জন্য করা হচ্ছে। সারা বছর কোনোভাবে ব্যবহার না করে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হলে সেটি সমস্যার। কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সারা বছর বসিয়ে রেখে বা খুব কম চালিয়ে সক্ষমতা ব্যয় পরিশোধ করা হলে বুঝতে হবে ওই কেন্দ্রটির দরকার নেই।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৯-১০ সালের বিদ্যুৎ খাত এবং এখনকার বিদ্যুৎ খাত এক নয়। তখন জরুরী ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সাথে চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তিগুলো ছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের। কিন্তু এরপর এগুলোর সাথে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলোÑ আমি বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আরো পাঁচটির সাথে চুক্তি করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুবিধা দিতে করা হয়েছে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের গড়ে সাড়ে ৭ থেকে ৮ টাকা যায়। কিন্তু বাস্তবে কেন্দ্রভিত্তিক হিসাবের সাথে কুইক রেন্টালযুক্ত করা হয়, তাহলে কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে সরকারকে প্রতি কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ কিনতে হয় ৬০০ টাকায়। এটা বসিয়ে রেখে ভাড়া দেয়ার কারণে হচ্ছে। আর এর চাপ কিন্তু দেশের মানুষকে নিতে হচ্ছে।
জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধি ও সঙ্কটের কারণে সারা দেশে এখন এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং চলছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের রাত ৮টার পর শপিংমল ও দোকানপাট বন্ধ। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। তবে ব্যবহার হয় মাত্র সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অতিরিক্ত সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হয়। ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ সরকারকে দিতে হচ্ছে। দেশে বিদ্যুৎ নতুন কেন্দ্র স্থাপন ও সেগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদর্শ কোনো মানদণ্ডও নেই। ২০১২ সালে একটি বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। একটিমাত্র কোম্পানি (সামিট গ্রুপ) দরপত্রে অংশ নেওয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেশি ধরা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে ‘বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট বা বিডব্লিউজিইডি’ এই তথ্য জানায়। দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত অবস্থা বসে বসে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা আদায় করা এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্ত, সরকার কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে। যার ফলে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা সরকারকে বহন করতে হচ্ছে।
বিডব্লিউজিইডি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বিপিডিবি ৩৭টি কোম্পানিকে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেছে সরকার। বর্তমান মূল্যে বিদ্যুৎ বিক্রি করার পরও এই ব্যয়ের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিপিডিবির বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। যা বিগত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের ৫৪.৫ শতাংশ বেশি। ৬৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন-ক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ ১২টি কোম্পানি ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রদত্ত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সামিট গ্রুপ। তাদের পরে পর্যায়ক্রমে রয়েছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক তথ্যে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে (জুলাই/২১-মার্চ/২২) ৬১টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ১১ হাজার ৩৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা। একই সময়ে ১২টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিপরীতে দিতে হয়েছে ৬৭৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ১৬টি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থ বছরের হিসেবে দেখা গেছে ৬২টি আইপিপি ও এসআইপিপি ১১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ওই অর্থ বছরে ১৯টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে চার্জ দিতে হয়েছে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি, বেসরকারি, ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ এ সময়সীমার মধ্যে ১৬টি সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ব্যয় হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড দক্ষিণকে ৪১৩ কোটি টাকা, ইলেকট্রিক জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) সিদ্ধিরগঞ্জকে ৩৩৯ কোটি, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ভেড়ামারাকে ৩২৬ কোটি, আশুগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ২৪৮ কোটি, আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড উত্তরকে ২৭২ কোটি, আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে (৫৭৩ মেগাওয়াট) ১৭৭ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল সিরাজগঞ্জ ইউনিট-১-কে ১২১ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল সিরাজগঞ্জ ইউনিট-২-কে ২১৪ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল সিরাজগঞ্জ ইউনিট-৩-কে ২২১ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল মধুমতিকে ১০২ কোটি, এনডব্লিউপিজিসিএল খুলনাকে ২৫৩ কোটি, ইজিসিবি হরিপুরকে ২২৫ কোটি, বিআর পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডকে ১৭৪ কোটি, ইজিসিবি সিদ্ধিরগঞ্জকে (২১০ মেগাওয়াট) ১১২ কোটি, আশুগঞ্জ ৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে ১৬ কোটি ও এনডব্লিউপিজিসিএল সোলার কোম্পানিকে ৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি খাতকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ক্যাপাসিটি পেমেন্টের সুযোগ রাখা হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী এ অর্থ দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এখন নতুন করে যেসব চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে, সেখানে এ বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তুলে নেয়া হচ্ছে। এখন নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্টএ রকম করে চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে।