রাহুগ্রস্ত জ্বালানী খাত!
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ আগস্ট ২০২২, ১২:৪৩:৩২ অপরাহ্ন
সম্প্রতি মিডিয়ায় ‘এলএনজি কিনতে এক বছরে ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো হচ্ছে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দিয়ে। কিন্তু বৈশ্বিক বাজারে এই জ্বালানী পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে আমদানি ব্যয়। গ্যাস অনুসন্ধানে অর্থের জোগান দেয়া না হলেও আমদানিতে বিপুল ব্যয় পেট্রোবাংলার ওপর আর্থিক চাপ বৃদ্ধি করছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এলএনজি আমদানি বাবদ সংস্থাটির খরচ হয়েছে ৪৬০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৬.৯৬ টাকা ধরে)। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জ্বালানী গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনোমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) বর্তমানে বৈশ্বিক এলএনজি’র বাজারে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। পেট্রোবাংলার বরাত দিয়ে এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে এলএনজি’র আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত অর্থবছরে সংস্থাটি পণ্য আমদানি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে। গত ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থ বছরে আনুমানিক হিসাবে এ ব্যয় ৪৬০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের অর্থ বছরের এলএনজি আমদানি ব্যয়ের দ্বিগুন। জ্বালানী বিভাগের হিসাব মতে, ২০২১-২২ অর্থ বছরে এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার মতে, স্পট এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় বর্তমানে দৈনিক ১৪০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। মাসের হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা। আর বছর শেষে তা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। ফলে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় কমানো গেলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে পেট্রোবাংলার ও দেখা গেছে, দেশের সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস সঞ্চালন করা হয়, তার মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ এলএনজি। এ পরিমাণ গ্যাস কিনতেই সংস্থাটিকে রফতানিকারক দেশগুলোকে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থ বছরে দীর্ঘমেয়াদী ও স্পট মার্কেটÑএ দু’টি উৎসে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে। লক্ষণীয় যে, গত অর্থ বছরে এ সময়ে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির এলএনজি’র প্রতি এসএমবিটিইউ’র মূল্য ছিলো ৯ থেকে ১০ ডলার। বর্তমানে তা ১৪ থেকে ১৫ ডলার। আর স্পট মার্কেটে দাম ছিলো ৪২ থেকে ৪৪ ডলার। ফলে দুই উৎসেই আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এভাবে এলএনজি আমদানিতে সরকারের গ্যাস খাত পরিচালনায় সিংহভাগ অর্থ চলে যাচ্ছে। এই অর্থের একটি অংশ যদি দেশের স্থল ও সাগরভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যয় করা হতো, তাহলে আরো বড় ধরনের গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যেতো। বিস্ময়কর হলেও সত্য, গত অর্থ বছরে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কাজে বরাদ্দ ছিলো মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে দেশে এলএনজি আমদানির বিপরীতে ১ শতাংশ অর্থও ব্যয় করা হয়নি অনুসন্ধান কার্যক্রমে।
দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রমে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়াত্ত তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স। জানা গেছে, দেশের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে আলাদা করে কোন বরাদ্দ থাকে না। বিভিন্ন প্রকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলে তার ওপর ভিত্তি করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। গত অর্থ বছরে বাপেক্সের আওতায় ৫টি প্রকল্পে গত অর্থ বছরের জন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ ছিলো। সেটা খরচও হয়েছে।
কথিত মতে দেশে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট এবং স্পট মার্কেট থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে গ্যাস আমদানি করা গেলেও স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল। আগামীতে স্পট মার্কেট অর্থাৎ খোলা বাজার থেকে এই এলএনজি আমদানি করা যাবে কি-না, তাও অনিশ্চিত। ফলে জ্বালানী ব্যবস্থাপনায় এক অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সর্বোপরি, দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম বন্ধ রাখার ফলে এবং দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় চাহিদা মোতাবেক গ্যাস আমদানি না করায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। মূলতঃ স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস ক্রয়ে কমিশন বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠনের জন্য এসব করা হয়েছে। এমন অভিযোগ ব্যাপক। এছাড়া এই দুর্নীতি অব্যাহত রাখার জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগেও গড়ে তোলা হয়নি দেশে কোন স্থায়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। উদ্যোগ নেয়া হয়নি দেশে কোন স্থায়ী বিদ্যুত ব্যবস্থা গড়ে তোলার। উদ্যোগ নেয়া হয়নি রিনিউয়েবল জ্বালানীর উৎস অনুসন্ধানে। এসবের চরম খেসারত এখন দিতে হচ্ছে ঘন্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ ও উৎপাদনের ক্ষয়ক্ষতি বহনের মধ্যে দিয়ে। কেউ জানে না কখন এবং কীভাবে এই রাহুর দশা কাটবে।