বিশ্ববাজারে মূল্যহ্রাসের সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৪৬:৫৪ অপরাহ্ন
গত কয়েক মাস যাবৎ বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলসহ অনেকগুলো নিত্যপণ্য বিশেষভাবে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের ভোক্তারা এর সুফল থেকে বঞ্চিত। গত কয়েক মাসে গম ও চিনির দাম অনেক কমেছে বিশ্ববাজারে, প্রতি বুশেল গমের দাম নেমে এসেছে ৭.৮৬ ডলারে। কিন্তু দেশের বাজারে এই অন্যতম খাদ্যপণ্যের দামে তেমন প্রভাব পড়েনি।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, বিশ্ববাজারে যেসব পণ্যের দাম পড়তির দিকে, সেগুলোর সুফল আমরা পাচ্ছি না। এর প্রধান কারণ ডলারের উচ্চমূল্য। আবার গ্যাস সংকটের কারণে স্থানীয় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ডলার সংকটের কারণে এখনো আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটার সমাধান না হলে আমদানি স্বাভাবিক হবে না। মেঘনা গ্রুপ বছরে ৮-৯ লাখ টন গম আমদানি করে থাকে, কিন্তু এ বছর তার অর্ধেকেরও কম আমদানি করেছে।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু চাল ও গম নয়, এই ৫ মাসে প্রায় ৬৫ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি, ২১ হাজার টন পেঁয়াজ এবং সাড়ে ৪ হাজার টন অপরিশোধিত পাম অয়েলও কম আমদানি হয়েছে। রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি পাউন্ড সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে ০.৮২০ ডলার পর্যন্ত হয়, যা এখন নেমে এসেছে ০.৭৩৪ ডলারে। কিন্তু দাম কমার সুফল দেশের বাজারে নেই।
টিসিবি’র বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে এক কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৩ টাকায়, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিলো সর্বোচ্চ ৩৪-৩৮ টাকা। একইভাবে প্যাকেটজাত আটার দাম ৫৮.৮২ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকায়। বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট না থাকলেও প্যাকেটজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯০ টাকা, চিনি ১১০-১২০ টাকা এবং মানভেদে মশুর ডাল ১২০-১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে সারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। ফলে আমন ধানের দাম মনপ্রতি ১৩০০ টাকার ওপরে। মোটা চাল ৫৫ টাকা এবং চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকারও ওপরে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারী পর্যায়ে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও চলতি অর্থ বছরের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২.৬২ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। বাণিজ্য সচিবের প্রতিবেদন অনুসারে, মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৫ মাসে চাল আমদানি হয়েছে ৩.০৫ লাখ টন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিলো ৯.০৮ লাখ টন।
গত ৩০ অক্টোবর দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ৪১৫ টি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে ১৭ লাখ ২ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এর মধ্যে মাত্র ৩.৮৫ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ডলার সংকট এবং ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে না পারায় বিশেষভাবে এলসির দায় নিস্পত্তি করতে না পারায় চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য পর্যাপ্ত পরিমানে আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে বেড়েছে এসব পণ্যের দাম। বর্তমানে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পেলেও এখনো ডলারের দাম অনেক বেশী। ডলারের ঘাটতিও বিদ্যমান। রফতানি আয় বাড়লেও প্রবাসী রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কোন লক্ষণ নেই।
সর্বোপরি, দেশ খাদ্যপণ্যের জন্য অস্বাভাবিকভাবে বিদেশ নির্ভর হওয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। ডলার সংকট এটাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ফলে আমদানি যেমন কমেছে, তেমনি দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। আর এই সুযোগকে পুঁজি করে ক্ষমতাসীন মহলের ঘনিষ্ঠ অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করেছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অসহনীয় যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ। দ্রব্যমূল্যের চাপে নাভিশ্বাস ওঠেছে তাদের। এই উপমহাদেশসহ বিশ্বের দরিদ্র মানুষ যখন খাদ্যপণ্যের মূল্যহ্রাসের সুফল পাচ্ছে, তখন এদেশের কোটি কোটি গরীব মানুষ রীতিমতো হাহাকার করছে। সব সংকটের মূল্য ডলার সংকট দূর না হলে এবং অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা বন্ধ না হলে এ অবস্থার আশু সমাধান হবে নাÑএমন অভিমত সচেতন মহলের। তাদের মতে, বিশ্ববাজারে এসব পণ্যের মূল্য যতোই হ্রাস পাক, বাজার ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু না হলে এর সুফল লাভ সুদূর পরাহত।