সিলেটের পর্যটনে ৫ প্রতিবন্ধকতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ৫:০৪:০৮ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : উঁচু টিলা, ঢেউ খেলানো চা বাগান, নীল জলের লালাখাল, পাথুরে বিছানায় ভেসে চলা ঝর্ণার ধারা কিংবা জলের মধ্যে ভেসে ওঠা অরণ্য-রাতারগুল। সঙ্গে হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহপরান (র.) মাজারসহ আরো অনেক পর্যটন স্পট। এ কারণেই বিনোদনপ্রেমিদের কাছে সিলেট সবসময়ই পছন্দের তালিকায়। এবারও সিলেটে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। তবে বর্তমানের পর্যটক উপস্থিতি মওসুম অনুযায়ী প্রত্যাশিত নয় বলেও জানিয়েছেন এ সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, সিলেটের সৌন্দর্যের মধ্যে রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যটক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে সিলেট।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিলেটের পর্যটন খাতের বিকাশের নানা প্রতিবন্ধকতার মূলে রয়েছে ৫ প্রতিবন্ধকতা। পর্যটন স্পটের অনুন্নত অবকাঠামো, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাহীনতা, ভাঙাচোরা সড়ক, সঠিক পরিকল্পনা ও প্রচারের অভাবে বিকশিত হচ্ছেনা সিলেটের পর্যটন খাত। ফলে বিপাকে পড়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটন খাতের সঙ্কট সমাধান এবং মানুষ আর প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পর্যটন অর্থনীতি বিপ্লব ঘটতে পারতো সিলেটে। এজন্য প্রয়োজন মহাপরিকল্পনা। সিলেটের পর্যটন শিল্পের কাঙ্খিত বিকাশ ঘটাতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ চান সংশ্লিষ্টরা। যদিও বর্তমান জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে সিলেটের পর্যটন ম্যাপ তৈরী করে তা জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে যোগ করা হয়েছে।
জানা গেছে, সিলেটের পর্যটনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে লাখো মানুষের ব্যবসা, বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকা। টানা ২ বছর করোনা মহামারী এবং চলতি বছরে ভয়াবহ বন্যার কারণে থমকে গিয়েছিল সিলেটের পর্যটন শিল্প। ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকা। যদিও করোনা মহামারী ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে পেছেনে ফেলে সিলেটের পর্যটন শিল্পে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে পর্যটক। এরপরও কয়েকটি চিহ্নিত সঙ্কটের কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্যটক আকৃষ্ট করতে পারছেনা সৌন্দর্য্যরে লীলাভুমি খ্যাত আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট।
সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্য পর্যটকদের কাছে দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় জায়গা সিলেট। বিভাগের ৪ জেলায়ই রয়েছে সুন্দর সুন্দর পর্যটন ¯পট। ফলে আসন্ন শীতের মওসুমকে ঘিরে এই খাতসংশ্লিষ্টদের মুখে ফিরেছে হাসি। টাঙ্গুয়ার নৌকাচালক, জাফলংয়ের ফটোগ্রাফার, বিছনাকান্দির প্রসাধনসামগ্রী বিক্রেতা থেকে শুরু করে বড় রিসোর্টের উদ্যোক্তারাও চলতি মওসুমে ব্যবসা নিয়ে আশাবাদী।
সরকারী লম্বা ছুটি এবং বিভিন্ন উৎসব ছাড়াও শীতকালে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল, মায়াবী ঝরনা, জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল, শাপলা বিল, রাজবাড়ি ও শ্রীপুর, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর, কানাইঘাটের লোভাছড়া ও নগরীর চা-বাগানগুলোতে পর্যটকের ঢল নামার দৃশ্য পুরনো।
পর্যটকদের পদচারণায় সদা মুখরিত থাকা মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান, বড়লেখার মাধবকুণ্ড, কমলগঞ্জের হামহাম জলপ্রপাত, হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পর্যকট উপস্থিতি বাড়লেও বর্তমানে আশা অনুযায়ী পর্যটক পাচ্ছেনা। মনোরম ও অভিজাত রিসোর্টের জন্য শ্রীমঙ্গলে পর্যটক সমাগম আশানুরুপ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে ৫ শতাধিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। যেগুলোর বেশির ভাগই পর্যটকনির্ভর। এছাড়া সিলেটের ৪ জেলায় শতাধিক পর্যটন স্পট রয়েছে। এসব স্পটে বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটে। এর মধ্যে সিলেট জেলায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ। মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ এবং হবিগঞ্জে প্রায় ২ লাখ পর্যটক এসে থাকেন। বিগত ২ বছরে করোনা পরিস্থিতি ও বন্যার কারণে এসব এলাকায় পর্যটক সমাগম প্রায় বন্ধই ছিল। তবে শেষ দিকে এসে ফের চাঙ্গা হতে শুরু করে পর্যটন খাতগুলো। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে খুব একটা জমে উঠেনি পর্যটন স্পটগুলো। তবে এই সময়ে সিলেটের কোন পর্যটনই পর্যটক শুন্য ছিলনা।
জানা গেছে, বছরের মাঝামাঝিতে সিলেটে কয়েকদফা বন্যা হয়। এর ক্ষত এখনো রয়ে গেছে। মহানগরসহ সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগ সড়ক ভাঙাচোরা। এসব সড়ক দিয়ে চলাচল করা পর্যটকদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। এমনিতে সিলেটের পর্যটন এলাকায় যাওয়া-আসার রাস্তাগুলো অনেক সরু এবং নিম্নমানের।
সিলেটের দুটি জনপ্রিয় পর্যটনস্পটের মধ্যে রয়েছে দেশের একমাত্র মিঠাপানির জলারবন রাতারগুল ও বিছানাকান্দি। এ দুটি পর্যটনস্পটই গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এ দুটি পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার সড়কই খানাখন্দে ভরা। এ কারণে ঘুরতে এসে ভোগান্তিতে পড়ছেন পর্যটকরা।
বিছনাকান্দির দূরত্ব সিলেট থেকে ৪১ কিলোমিটার। এই পথের মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলার বঙ্গবীর রোড থেকে হাদারপাড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বন্যার পানি নামার পর সড়কের পিচ উঠে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে, সেই ভাঙাচোরা সড়ক এখনো সংস্কার হয়নি।
রাতারগুলের অবস্থান সিলেট থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। এ সড়কের পাঁচ কিলোমিটার অংশ ভাঙাচোরা। আবার চানুপুর থেকে মোটরঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক কাঁচা। এ কারণে বৃষ্টির দিনে যাতায়াতে সমস্যা হয় ব্যাপক। সিএনজিচালিত অটোরিকশা আর লেগুনা ছাড়া কোনো গাড়িই যেতে চায় না রাতারগুল ও বিছানাকান্দিতে।
সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর। সিলেট-ভোলাগঞ্জ চারলেন সড়কের অবস্থা ভালো। কিন্তু সাদাপাথরে পর্যটকদের জন্য ওয়াশ রুম, চেঞ্জ রুমসহ অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। জাফলং, রাতারগুল, উৎমাছড়া, মায়ারবন, বিছানাকান্দি, বাংলার নীলনদ খ্যাত সারি নদীসহ সিলেটের বেশিরভাগ পর্যটনকেন্দ্রেই নেই ব্যবহার উপযোগী ওয়াশরুম ও পোশাক পরিবর্তনের সুবিধা। যার কারণে পর্যটকরা এসব এলাকায় গিয়ে পানিতে ভেজার পর পোশাক পরিবর্তন করতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি।
এ বিষয়ে হোটেল এন্ড গেস্ট হাউস আর্নার্স গ্রুপ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক নওশাদ আল মুক্তাদির দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ডিসেম্বরের শুরুতে সিলেটে যে পরিমাণ পর্যটক আসার কথা ছিল, মাসের মাঝামাঝি সময় চলে এলেও আশানুরূপ পর্যটকের আগমন ঘটেনি। দেশে নানা সঙ্কট আছে ঠিক, এরপরও সিলেটের মানুষ প্রতিদিনই কক্সবাজার-কুয়াকাটা যাচ্ছে। বিমানের টিকিট মিলছেনা। কিন্তু সিলেটে পর্যটক কমছে।
তিনি বলেন, জাফলং-ভোলাগঞ্জ রাস্তা ভালো। বিছনাকান্দিসহ অন্যান্য স্পটের রাস্তা খারাপ। এ কারণেও পর্যটক কমছে। এছাড়া নিরাপত্তাজনিত সমস্যা ত আছেই।
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, সিলেটের পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। ধীরে ধীরে এগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। বন্যায় সিলেটের বেশিরভাগ সড়কেরই ক্ষতি হয়েছে। এসব সড়ক সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন একটা ওয়েবসাইট করছে। যেখানে পর্যটকরা সিলেট সম্পর্কে সব তথ্য পেতে পারেন সহজে।
তিনি বলেন, আমার জানামতে সিলেটে পর্যটক সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সিলেটে পর্যটক আসছে। সঠিকভাবে প্রচার হলে পর্যটক সংখ্যা বাড়বে।