বিজয়ের ৫১ পেরিয়ে…
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ৪:৫৪:৫১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ প্রতিবেদন : আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। স্বাধীনতাপ্রিয় বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জনের দিন। তবে এবারের এ দিনটি আরো বেশী গৌরবের। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ ৫১ পূর্ণ করে ৫২ এর নতুন অধ্যায়ে পা দিচ্ছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের পর এ যেন আরেকটি অর্জনের ‘৫২’।
৫১ বছর পূর্ণ একটি জাতির জীবনে দীর্ঘসময় যেমন নয়, তেমনি খুব কম সময়ও নয়। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের আকারে ছোট হতে পারে, কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে ছোট কোনো দেশ নয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সুবর্ণজয়ন্তী যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের জন্য আজকের দিনটি যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ, তেমনি আত্মজিজ্ঞাসারও। ৫১ বছরের অর্জন-সাফল্য ও ব্যর্থতা নির্মোহভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার দিনও আজ।
বিজয়ের ৫১ পেরিয়ে আজ যেমন আনন্দমুখর ৫৬ হাজার বর্গমাইল। তেমনি এই আনন্দের মাঝে শত প্রশ্নও জমা হয়েছে কোটি হৃদয়ে। এই পাঁচ দশকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা সুসংহত হয়েছে। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, সংসদ ও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করছে-এমন প্রশ্ন সামনে রেখে আজ উদযাপিত হবে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী।
নি:সন্দেহে ৫১ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। পদ্মা সেতু নির্মাণসহ অবকাঠামোগত দিক দিয়ে নি:সন্দেহে নতুন দিগন্ত স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো এখনো প্রশ্নের মুখে। আজ রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান নেই। তাদের মাঝে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চাও অতটা নেই। কেবলই কাঁদা ছুঁড়াছুড়ি। কথা ও আইনের মারপ্যচে একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা তো চলছেই। দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা কম থাকায় রাষ্ট্রের গণতন্ত্রও এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই দেশে-বিদেশে। শুধু তাই নয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও প্রশ্নের মুখে। পিছিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায়ও। তবুও নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত ছুঁয়ার শপথে সারা দেশের মানুষ ও প্রবাসী বাংলাদেশীরা আজ দিনটি পালন করবে বিপুল আনন্দ-উৎসবে, এক সমুদ্র আশা নিয়ে। একই সঙ্গে বেদনা নিয়ে। দেশের স্বাধীনতার জন্য যে অকুতোভয় বীর সন্তানেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, কৃতজ্ঞ জাতি গভীর বেদনা ও পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে সেই মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সন্তানদের।
স্বাধীনতার জন্য বাঙালিকে দীর্ঘ সংগ্রামদীপ্ত পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল, সেখানেও বাঙালিদের ওপর নেমে এসেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, নির্যাতন। প্রথম আঘাত এসেছিল মাতৃভাষার ওপর। ১৯৫২ সালে বুকের রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে বাংলা মায়ের সন্তানেরা মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্বে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীকার চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল, আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কালক্রমে তা স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার সামনে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে শত্রুদের মোকাবিলার জন্য যার কাছে যা আছে তা-ই নিয়ে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র, নিরপরাধ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। বর্বর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল তারা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে সেই রাতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। তবে তার আগেই তিনি বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। একই দিন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
এরপর রণাঙ্গনে বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর নির্দেশনায় দেশের বীর সন্তানেরা হানাদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস প্রবল প্রতিরোধ সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেন। এক মহাসংগ্রামের পর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও সহায়-সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে এক অনবদ্য বিজয় কাব্য রচিত হয়।
আজ থেকে ঠিক ৫১ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। সেদিন পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের। লাল-সবুজ পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলো বিজয়ী বাঙালিরা। সেই পতাকা উঁচিয়ে চলছে আমাদের অভিযাত্রা। সীমাবদ্ধতার পাহাড় ডিঙিয়ে মানুষ গাইছে বিজয়ের জয়গান।
কিন্তু বিজয়ের অর্ধ শতাব্দি পেরিয়ে এসেও গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে কিনা তা-ই এখন বড় প্রশ্ন। শুধু তাই নয়, আরো হাজারো প্রশ্নের পাহাড়ে দাঁিড়য়ে আজ পালিত হবে বিজয় দিবস।