জুড়ীর বধ্যভূমি ও নির্যাতনশালা বিজয়ের ৫১ বছরেও সংরক্ষণ হয়নি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ৬:৩১:৩৭ অপরাহ্ন
জুড়ী প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের জুড়ীতে মহান স্বাধীনতার ৫১ বছরেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনশালা ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ হয়নি। নির্মাণ হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। সরকার সারাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতনশালা ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করছেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জুড়ীতে তা করা হয়নি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তখন অনেকেই শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। আবার অনেকে বাড়ি-ঘর, জমি-জমা, সংসার, আত্মীয়-স্বজনকে ফেলে রেখে না গিয়ে কোন রকমে থেকে যেতে চাইলেন। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনায় সে সুযোগ তারা পায়নি। জুড়ী শহরের বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন চিকন মিয়ার দোতলা ভবনে পাকিস্তানী আর্মি তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন দাউদ ও তার সহযোগীরা সে ক্যাম্পকে পরিণত করে নির্যাতনশালায়। স্থানীয় রাজাকার, আল্-বদর, আস্-সামস ও দালালদের সহযোগীতায় স্থানীয় ও বাহিরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে উক্ত ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন করে, মহিলাদের ধর্ষণ করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে লাশ ভবনের পেছনের পুকুরে ফেলে দিত। ক্যাপ্টেন দাউদ খানের নেতৃত্বে উক্ত ক্যাম্পে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় সুন্দরী মহিলাদের ধরে এনে ধর্ষণযজ্ঞে লিপ্ত হতো তারা। অসহায় কুমারী-মহিলাদের পাকিস্তানি নরপশুরা খুবলে খাওয়ার সময় অনেক দুরে থেকে তাঁদের চিৎকার-কান্নাকাটির শব্দ শোনা গেলেও এদের সাহাযার্থে এগিয়ে আসার সামর্থ্য কারো ছিল না। উপরস্তু পুরো এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করতো। মুক্তিযোদ্ধা মাসুক-এর বাড়ি ও জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন জাগোধারী নুনিয়ার বসতবাড়ি উক্ত পুকুরে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে গাড়ি ভর্তি করে মানুষের লাশ এনে ফেলতো।
৫ ডিসেম্বর ’৭১ জুড়ী শত্রু মুক্ত হলে শুরু হয় ঘরে ফেরা। মুক্ত জুড়ীতে ফিরে অতিপরিচিত স্থান গুলো সবার কাছে যেন অপরিচিত মনে হলো। চারদিকে শুধু ধ্বংশযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের রাঘনা সাব-সেক্টর কমান্ডার আব্দুল জলিল মাসুক বাড়ি ফিরে দেখেন উক্ত পুকুরকে ঘিরে শত শত কুকুর ও শকুন সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের লাশ টেনে-হিঁচড়ে খাচ্ছে। জীবদ্দশায় তাঁর মুখ থেকে শোনা যায়, তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য তৈমুছ আলী, ওসি শফিকুল হক পাঠানকে ডেকে এনে তিনি এই দৃশ্যটি দেখান। ধীরে ধীরে সেখানে ভিড় করেন মুক্তিযোদ্ধাসহ বহু উৎসুক মানুষ। স্বজন হারানোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সবাই। হাতের শাঁখা, চুল, ছেড়া শাঁড়ি, ব্লাউজ, ছায়া, বুকের পাঁজর, শরীরের হাঁড় আর অসংখ্য মাথার খুলি যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এ এক করুণ দৃশ্য, যা দেখে তখন পুরো এলাকায় মাতম শুরু হয়। হাঁউ মাঁউ করে কেঁদে উঠেন সবাই। হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে খুঁজতে থাকে অনেকেই। যুদ্ধ থেকে ফেরা মুক্তিযোদ্ধা ছত্তই মিয়া শনাক্ত করেন তাঁর পিতার বিকৃত লাশ। তবে, লাশ গুলো বিকৃত আর বিস্মৃত হয়ে যাওয়ায় আর কাউকেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরে বাঁশ দিয়ে ভার তৈরি করে গণহারে লাশগুলো এখানেই দাফন করা হয়।
জুড়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার কুলেশ চন্দ্র চন্দ মন্টু, আব্দুল আজিজ বলেন, ‘এটি জুড়ীর বৃহৎ বধ্যভূমি। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এ স্থানটি বড় অযন্তে পড়ে আছে। এ বৃহৎ বধ্যভূমি ও নির্যাতনশালার কথাটি এ প্রজন্মের অনেকেই জানে না। স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও এই বধ্যভূমি ও নির্যাতনশালা সংরক্ষন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কোন উদ্যোগ কোন সরকারের আমলেই নেয়া হয়নি। ফলে লোকচক্ষুর অন্তরালে এই স্মৃতি গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালদের অপকর্মের ফিরিস্তি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম জানে না, পরবর্তী প্রজন্মও জানবে না’।
জুড়ীর সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি জাগোধারী পুকুর ও পাকিস্তানী হানাদারদের নির্যাতনশালা সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে তার ইতিহাস ফুটিয়ে তোলার সময় বয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ১৪ বছর ক্ষমতায় আসীন। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নিকট মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জুড়ীবাসীর জোর দাবি, বিলীন হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহ জুড়ীর বৃহৎ বধ্যভূমি জাগোধারী পুকুর ও নির্যাতনশালা সংরক্ষণ করে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হোক।