আলোচিত শিশু রাজন হত্যাকাণ্ড : পাঁচ বছর ধরে ঝুলে আছে আপিল শুনানি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:০০:৩৩ অপরাহ্ন
এ টি এম তুরাব :
পাঁচ বছর ধরে আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে সিলেটের সবজি বিক্রিতা শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলা। কবে আপিল শুনানি শুরু হবে, তা নির্দিষ্ট করে কেউই বলতে পারছে না। সর্বোচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় আসামিদের সাজা কার্যকর করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৭ সালে রাজন হত্যা মামলায় চার আসামির মৃত্যদণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। আলোচিত এই মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আসামিদের চ‚ড়ান্ত আপিল শুনানি এখনো শুরুই হয়নি। মামলার দু’পক্ষই এখন চ‚ড়ান্ত আপিল শুনানির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
জানা যায়, সিলেট সদর উপজেলার কান্দিরগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের আজিজুর রহমানের ছেলে শিশু সামিউল আলম রাজন (১২)। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেট শহরতলীর কুমারগাঁওয়ে চুরির সন্দেহে রাজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের সময় এ দৃশ্যটি ভিডিওতে ধারণ করে নির্যাতনকারীরা। পরে ২৮ মিনিটের সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। হত্যাকাণ্ডের পর এসএমপির জালালাবাদ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বাদী হয়ে মুহিত আলমসহ অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে গিয়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতার অভিযোগে বরখাস্ত হন জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, এসআই জাকির হোসেন ও আমিনুল ইসলাম।
হত্যাকাণ্ডের দুই দিনের মাথায় মামলার মূল আসামি কামরুল ইসলাম পালিয়ে সৌদি আরবে চলে যান। পরে ভিডিও দেখে প্রবাসীদের সহযোগিতায় তাকে আটক করে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
দেড় মাসের মধ্যে রাজন হত্যার তদন্ত শেষ করে ওই বছরের ১৬ অগাস্ট আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) সুরঞ্জিত তালুকদার। এতে ১৩ জনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন সিলেট সদর উপজেলার কুমারগাঁও শেখপাড়ার মৃত আবদুল মালিকের ছেলে কামরুল ইসলাম, তার ভাই শামীম আহমদ, দিরাই উপজেলার জাকির হোসেন পাভেল, কামরুলের ভাই মুহিদ আলম, আলী হায়দার, তাজ উদ্দিন আহমদ বাদল, ময়না চৌকিদার, রুহুল আমিন, দুলাল আহমদ, এসএমপির জালালাবাদ থানার পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের নিজাম উদ্দিনের ছেলে ভিডিওচিত্র ধারণকারী নুর মিয়া, ফিরোজ মিয়া, আছমত উল্লাহ ও আয়াজ আলী।
মাত্র ১৭ কার্যদিবসে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সিলেট মহানগর দায়রা জজ আকবর হোসেন মৃধার আদালত রাজন হত্যার দায়ে মূল আসামি কামরুলসহ ৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন, ময়না চৌকিদার, তাজউদ্দিন আহমদ বাদল ও জাকির হোসেন পাভেল আহমদ। এ ছাড়া ১৩ আসামির মধ্যে নূর মিয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, কামরুলের তিন ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ও শামীম আহমদকে ৭ বছরের কারাদণ্ড। এ ছাড়া দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীকে ১ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় ফিরোজ মিয়া, আজমত উল্লাহ ও রুহুল আমিন নামের ৩ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের দুই দিন পরে এই মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পৌঁছে। পরে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন। তারপর ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ১২ মার্চ বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ের জন্য ১১ এপ্রিল দিন ধার্য করেন।
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল হাইকোর্ট বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৪ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। এ ছাড়া নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি নূর মিয়ার দণ্ড কমিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মামলার প্রধান আসামি কামরুলের তিন ভাই মুহিত আলম, আলী হায়দার ও শামীম আহমদের ৭ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। অপর আসামি দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীর ১ বছরের সাজাও বহাল রাখেন আদালত। আসামিদের মধ্যে জাকির হোসেন পাভেল এবং কামরুলের ভাই শামীম আহমদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক। হাইকোর্টে রাজন হত্যা মামলার রায় প্রকাশের পর পরই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা আপিল করেছেন। তবে কখন চ‚ড়ান্ত আপিল শুনানি শুরু হবে তা সংশ্লিষ্ট কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য এ এফ এম রুহুল আনাম চৌধুরী মিন্টু দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, শিশু রাজন হত্যা মামলার আপিল বর্তমানে কোন পর্যায়ে আছে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে আপিল বিভাগে মামলার ধারাবাহিকতায় আপিল শুনানি হয়ে আসছে। নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শিশু রাজন হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু হবে জানিয়ে তিনি বলেন, মামলার বাদি এজন্য অগ্রহ দেখাতে হবে।