মানসম্পন্ন কলেজে ভর্তি নিয়ে শঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১০:১৭ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : ২২ জানুয়ারী থেকে সিলেটসহ সারাদেশে শুরু হতে যাচ্ছে একাদশ শ্রেণীর ভর্তি কার্যক্রম। ২৬ জানুয়ারী থেকে শুরু হবে ক্লাস। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের গত ৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু অনলাইনের আবেদন শুরু হয়ে ১৫ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। আবেদনের সাথে সাথে চাহিদামতো কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া নিয়ে সর্বত্র চলছে জল্পনা-কল্পনা। ভর্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা না থাকলেও ‘ভালো’ কলেজে সুযোগ পাওয়া নিয়েই রীতিমতো দুশ্চিন্তায় আছেন পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জনকারী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। মানসম্মত হিসেবে পরিচিত সিলেট বিভাগের ১০টি কলেজের আসন সীমিত থাকায় কাঙ্খিত কলেজে ভর্তি নিয়ে চলছে উদ্বেগ।
জানা গেছে, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আসন সংকট না থাকলেও ভালো কলেজে আসন সংখ্যা সীমিত। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২। গত বছরের তুলনায় জিপিএ ৫ বেড়েছে ৮৬ হাজার ২৬২টি। তাই ১ লাখ ৭৬ হাজার মেধাবীকে মানসম্মত কলেজে স্থান করে দেওয়া রীতিমত চ্যালেঞ্জের বিষয়। সারাদেশের ন্যায় সিলেটে কলেজ বাড়লেও সব প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অথচ এবারও জিপিএ ৫ পেয়ে অনেককে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভর্তি হতে হবে মানহীন কলেজে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে একাদশ শ্রেণিতে আসন ২৫ লাখ। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছে ৫ লাখ আসন। এবার মাধ্যমিকে ১১টি বোর্ড মিলে পাস করেছে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৯ জন। সে হিসাবে অন্তত সাড়ে ৭ লাখ আসন খালি থাকার কথা।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, সিলেটে পর্যাপ্তসংখ্যক কলেজ থাকায় ভর্তির সুযোগ সব শিক্ষার্থীই পাবে। তবে আসনের স্বল্পতা থাকায় জিপিএ ৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই পছন্দমতো কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠান না হলেও তুলনামূলকভাবে ভালো কলেজেই মেধাবীরা ভর্তির সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাব বলছে, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮ হাজার ৮৬৪টি। এর মধ্যে ‘মানসম্মত’ কলেজের সংখ্যা পৌনে ২০০। এসব কলেজে আসন সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো। তাই সর্বোচ্চ ভালো ফল করা ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ওই সব কলেজে আসন পেতে লড়াই হবে। এ হিসাবে চাইলেও সবাই পছন্দের ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবেন না।
ব্যানবেইসের হিসাবে, ঢাকা বিভাগে ৭০টি, রংপুর বিভাগে ২৯টি, বরিশাল বিভাগে ১২টি, রাজশাহী বিভাগে ৫টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭টি, খুলনা বিভাগে ১১টি এবং সিলেট বিভাগে ২২টি মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কলেজে নিজ নিজ বিভাগের জিপিএ-৫ ধারীরাও ভিড় করলে সবার ভর্তির সুযোগ হবে না।
জানা গেছে, এবার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯০ হাজার ৯৪৮ জন। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ হাজার ৫৬৫ জন এবং জিপিএ-৪ পেয়েছে ২৩ হাজার ৯৭০ জন। অর্থাৎ, ভালো ফলাফলে এসএসসি উত্তীর্ণ ৩১ হাজার ৫৬৫ জন শিক্ষার্থীর অনেকে চাহিদামতো ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে না। সিলেট বোর্ডে ২৩টি ভালো মানের কলেজ থাকলেও এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে- সিলেট এমসি কলেজ, সিলেট সরকারী কলেজ, সিলেট সরকারী মহিলা কলেজ, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিলেট ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিলেট সরকারী অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ, সুনামগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজ, হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজ, হবিগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজ, মৌলভীবাজার সরকারী কলেজ, মৌলভীবাজার সরকারী মহিলা কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ শমসেরনগর। এসব কলেজে আসন সংখ্যা রয়েছে ১০ সহস্রাধিক, যা শিক্ষার্থীর চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ। বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন বেশি বিড়ম্বনায়।
এবার সিলেটে বিজ্ঞান বিভাগে উত্তীর্ণ ২৩ হাজার ২৩০ জনের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ৮৯৪ জন এবং জিপিএ-৪ পেয়েছে ১১ হাজার ৪৫১ জন। এ বিভাগে ভালো ফল করেও প্রত্যাশিত কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে অনেকের মধ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে অভিভাবকদের মধ্যেও। সিলেটে ভালো কলেজগুলোয় বিজ্ঞান বিভাগে আসন রয়েছে ৩ সহস্রাধিক।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, চাহিদার সঙ্গে সিলেটের ভালো কলেজগুলোর আসনের কোনো সংগতি নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যাশিত ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন নামিদামি ও প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আসন বৃদ্ধি করা। শিক্ষা নিয়ে সিলেটে যে বাণিজ্যিক মানসিকতা তৈরি হয়েছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সিলেটে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদন না দিয়ে মানসম্মত কলেজগুলোয় আসন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট এমসি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ৩০০ আসন রয়েছে। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে ৭০০ আসন রয়েছে। যার মধ্যে বিজ্ঞানে ৩৫০ ও মানবিক বিভাগের ৩৫০। সিলেট সরকারী কলেজে ৯০০ আসনের মধ্যে ৩০০ বিজ্ঞান, ৩০০ মানবিক ও ৩০০ ব্যবসায় শিক্ষা। সিলেট সরকারী অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০ বিজ্ঞান ও ১৫০ ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের। জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ (ইংরেজী ভার্সন) ডে শিফটের ৩০০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞান ১৫০, মানবিক ৭৫ ও ব্যবসায় শিক্ষার ৭৫ আসন এবং একই কলেজের মর্নিং শিফটে (ইংরেজী ভার্সন) বিজ্ঞানে ৭০, মর্নিং শিফট (বাংলা ভার্সন) বিজ্ঞানে ৩০০, মর্নিং শিফট (বাংলা ভার্সন) মানবিকে ১৫০ ও মর্নিং শিফট (বাংলা ভার্সন) ব্যবসায় শিক্ষার ২০০ আসন রয়েছে। সিলেট ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ২৪০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ১২০, মানবিকে ৬০ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ৬০ আসন আছে। বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের ৩১০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ১৫০, মানবিকে ৮০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৮০ আসন রয়েছে। ব্লু বার্ড হাই স্কুল এন্ড কলেজের ৪৫০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ১৫০, মানবিকে ১৫০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ১৫০ আসন আছে।
সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজে ১০৫০ টি আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ৩০০, মানবিকে ৪৫০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৩০০ আসন রয়েছে। সুনামগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজে ৭০০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ১৫০ ও মানবিকে ৫৫০ আসন রয়েছে।
মৌলভীবাজার সরকারী কলেজে ১২০০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ৩০০, মানবিকে ৪৫০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৪৫০ আসন রয়েছে। মৌলভীবাজার সরকারী মহিলা কলেজে ১২০০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ১৫০, মানবিকে ৬০০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৪৫০ আসন রয়েছে। এছাড়া মৌলভীবাজার বিএএফ শাহীন কলেজ শমসেরনগরের ৫০০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ২০০, মানবিকে ১৫০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ১৫০ আসন রয়েছে।
হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারী কলেজের ১৩০০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ৩০০, মানবিকে ৬০০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ৪০০ আসন রয়েছে। হবিগঞ্জ সরকারী মহিলা কলেজের ৭৫০ আসনের মধ্যে বিজ্ঞানে ১৫০, মানবিকে ৪৫০ ও ব্যবসায় শিক্ষায় ১৫০ আসন আছে।
গত ৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় একাদশে ভর্তির অনলাইন আবেদন কার্যক্রম। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা অনলাইনে এক সাথে পছন্দের ১০টি কলেজে আবেদন করেছেন। কিন্তু সিলেট বিভাগে পছন্দ করার মতো ভালো ১০ টি কলেজে আবেদন করতে পারেননি অনেকেই। ভর্তি সমস্যা দূর করতে শিক্ষার্থীরা ভালো কলেজে আসন সংখ্যা বাড়ানোর দাবী জানালেও শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ বলেছেন, আসন বাড়িয়ে নয়, মান সম্পন্ন কলেজের সংখ্যার পাশাপাশি ও সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানবৃদ্ধি করতে হবে।
সিলেট এম সি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর আশরাফুল কবীর দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এম সি কলেজ বিশাল বড় কলেজ। এখানে উচ্চতর শিক্ষার পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। তাই মেধাবী শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে এম সি কলেজ।
তিনি বলেন, এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫, জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা এই কলেজে ভর্তি হয়। আমরা এসব মেধাবীদের মেধার ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। পুরো বছর অনার্স, মাষ্টার্স ও ডিগ্রি সহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ততার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষকগণ একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় গাইডলাইন দিয়ে থাকেন। ফলে এম সি কলেজের প্রতি মেধাবীদের আগ্রহ বেশী। তবে চাইলেই সব মেধাবীদের ভর্তি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আসনের সীমাবদ্ধতা আছে।
এ বিষয়ে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. রমা বিজয় সরকার দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমার বোর্ডের কোন কলেজকেই আমি খারাপ বলতে পারিনা। তবে ভালো মানের কলেজে ভালো ফলাফল অর্জনকারীরা ভর্তি হয় বিধায় সেই কলেজগুলাতে এইচএসসিতেও ভালো ফলাফল হয়। ফলাফল অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে। একটি কলেজে একাধিক শিক্ষার্থীর পছন্দ থাকাটা স্বাভাবিক। তবে সবাইকে ভর্তি করা ঐ কলেজের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারী ও ভালো মানের কলেজে আসন বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের তেমন কোন চাহিদা নেই। তবে সকল কলেজে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে আমরা জোর তৎপরতা চালাবো।