সন্ধ্যা নামলেই মশার ঝাঁক!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১০:৫৯ অপরাহ্ন
জনবল সংকটের দোহাই সিসিকের
এমজেএইচ জামিল :
মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না নগরবাসী। হু হু করে বাড়ছে মশা। বড় আকৃতির এসব মশার যন্ত্রণায় শুধু ঘরেই নয়, অফিস আদালতে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা হলেই এই মশার ভঁনভঁন শুরু হয়। রাতে শুধু বাসায় নয়, দিনেও অফিস-আদালত, হাসপাতাল, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনসহ মানুষের উপস্থিতির স্থানে মশার উপদ্রব অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
সন্ধ্যার পর গোটা নগরী যেন মশার দখলে চলে যায়। মশার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মানুষ কয়েল, মশা তাড়ানোর স্প্রে, ইলেক্ট্রিক ব্যাট কিনে মশা থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে। ফলে বাজারে মশা তাড়ানোর ওষুধ ও পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এদিকে মশার উপদ্রব বৃদ্ধির জন্য জনবল সংকটের কারণে সকল ওয়ার্ডে এক সাথে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারাকে দায়ী করছে সিসিক। একই সাথে সীমিত জনবল ও সামর্থ নিয়ে ধারাবাহিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এর সুফল মিলছেনা বলেও জানান তারা।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের মতে, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে ৪ গুণ। বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময়ে একই চিত্র থাকে কিউলেক্স মশার উপদ্রবের। কিউলেক্স মশার প্রজননস্থলগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য ডোবা-নালা বা জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। সঠিক নিয়মে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
নগরীর বন্দরবাজার, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, ফাজিল চিশত, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, আখালীয়া, মির্জা জাঙ্গাল, কাজলশাহ, ভাতালিয়া, শামীমাবাদ, শেখঘাট, রিকাবী বাজার, তালতলা, মাছুদঘীরপাড়, সোবহানীঘাট, উপশহরসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গত নভেম্বর মাসের চেয়ে চলতি ডিসেম্বর মাসে নগরীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মানুষ বড় আকৃতির মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে ডেঙ্গুরোগীর সন্ধান পাওয়া গেলেও এডিস মশার আতঙ্ক ছিলনা। সে হিসেবে নগরীতে এডিস মশার ভয় না থাকলেও বড় আকৃতির কিউলেক্স মশা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিউলেক্স মশার কারণে ফাইলেরিয়া ও ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। নভেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত এর উৎপাত থাকে বেশি। সিলেট সিটি কর্পোরেশনে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেশি। এতে ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী। তাদের অভিযোগ, গোটা নগরজুড়েই মশার উপদ্রব অসহনীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সূর্য ঢলে পড়তেই ঘরে-বাইরে মশার যন্ত্রণা শুরু হয়। আর মশক দমনে সিটি কর্পোরেশনের মান্ধাতার আমলের কৌশল বাদ দিয়ে নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রনয়ণের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন নাগরিকবৃন্দ।
নগরীর কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, খাল ও নর্দমা ছাড়াও বস্তি, রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড়, বাসস্ট্যান্টের বিভিন্ন খোসা, ঝোপঝাঁড়, টায়ারের দোকান, দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা মোটরযান মশা জন্মানোর উপযুক্ত স্থান। এছাড়া ঢালাই মেশিন, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পলিথিন, ককসীট, বিভিন্ন মার্কেটের পরিত্যাক্ত ছাদ, দুই বাড়ির মাঝের পেসেজে বৃষ্টির পানি ও ভবনের টেংকীর পানি জমে সেখানে মশা জন্মাচ্ছে। এ ছাড়াও ছাদকৃষি যারা করেন তাদের বাগানে ফুলের টবে পানি জমে মশার লার্ভা জন্মায়। নির্মাণাধীন ভবনে বেশি মশা দেখা যায়। নির্মাণাধীন ভবনে ঠিকাদার ও বাড়ি মালিকদের অসচেতনায় সেখানে জন্ম নিচ্ছে এডিস ও কিউলেক্স উভয় ধরনের মশা। এসব মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন তেমন কোনো কার্যকারী পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেটে শুরু থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে এসে কিউলেক্স মশার উপদ্রব অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। কিউলেক্স ও এডিস মশা নিধনের জন্য খাল, বিল, নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। মশা নিধনে লার্বিসাইট প্রয়োগ এবং ফগার মেশিনের ব্যবহারের নিয়মিত কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। জনবল সংকট ও মশক নিধন যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতার কারণে কয়েকটি ওয়ার্ডকে ভাগ করে কাজ করতে গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রমে কাঙ্খিত সফলতা মিলছেনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর শামীমাবাদ-কানিশাইল, শেখঘাট-বেতেরবাজার, জালালাবাদ আবাসিক এলাকাসহ কয়েকটি জনবহুল এলাকায় মশার উৎখাত বহুগুণে বেড়েছে। এমনকি সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ের আশেপাশের বন্দরবাজারের বিভিন্ন অফিস-আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মশার উৎপাত কয়েকগুণ বেড়েছে। এসব এলাকায় ঘন ঘন মশা তাড়ানোর ঔষুধ ছিটাতেও দেখা গেছে। এরপরও মশার উৎপাত না কমায় এসবের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এদিকে কয়েকটি এলাকার স্থানীয়রা জানান, প্রজনন স্থান খাল ও নর্দমা পরিষ্কার করা বা সেখানে ওষুধ প্রয়োগ নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওয়ার্ডভিত্তিক মশক নিধন শ্রমিক বাড়ানোর পাশাপাশি উন্নতমানের মানসম্পন্ন মশা তাড়ানোর কীটনাশক স্প্রে’র ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ দরকার সেসব ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের দুর্বলতা রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করা গেলে মশার উপদ্রব এত বৃদ্ধি পেত না।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: জাহিদুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা নিয়মিত ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করছি। সিলেটে এডিস মশার বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর পদক্ষেপের ফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সারাদেশের তুলনায় ভালো আছে। আমরা ডেঙ্গুর পাশাপাশি কিউলেক্স মশার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। নগরীর ছড়া খাল নালা নর্দমা পরিষ্কার করে এসব স্থানে লার্বিসাইট প্রয়োগ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে করা হচ্ছে ফগিং। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ফগিং করার পর ৩/৪ দিন মশা কমলেও ৫দিন পর আবার সেই পুরনোরূপে ফিরে যায়। আমরা যদি ওয়ার্ডভিত্তিক কমপক্ষে ৩জন লোক স্থায়ীভাবে নিয়োগ করে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে পারি তাহলে মশক নিধনে ভালো ফলাফল আসতে পারে। আমি ইতোমধ্যে সিসিক কর্তৃপক্ষের কাছে এ সংক্রান্ত একটি কর্মপরিকল্পনা দিয়ে রেখেছি। শুধু সিসিকের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এলাকা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে নগরবাসীকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে।
তিনি বলেন, মশকনিধনে আমাদের সীমাবদ্ধতাজনিত কারণ যেমন কিছু রয়েছে, তেমনিভাবে নাগরিকসৃষ্ট কিছু সমস্যাও এর জন্য বহুলাংশে দায়ী। ময়লা ফেলার নিদিষ্ট ডাস্টবিন ও স্থান থাকা সত্ত্বেও বাসা বাড়ীর আঙ্গিনা, ড্রেন, ছড়া ও খালে ময়লা ফেলে পরিবেশ নোংরা করা হচ্ছে। এতে মশার প্রজনন কেন্দ্র সৃষ্টি হচ্ছে। মশক নিধনে ব্যবহৃত লার্বিসাইটের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুুযোগ নেই। কারণ সরকারীভাবে এর চেয়ে বেশী শক্তিসম্পন্ন কীটনাশক ব্যবহারের অনুমতি নেই। পরিবেশের বিষয়টি মাথায় নিয়েই আমাদেরকে মশক নিধনের ঔষধ ব্যবহার করতে হচ্ছে। শীঘ্রই মশক নিধনে কার্যক্রম আরো জোরদার করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।