বছরের আলোচিত ঘটনা -দুর্ঘটনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ৫:১৯:৪৫ অপরাহ্ন
এ টি এম তুরাব :
সূর্য ওঠে, অস্ত যায়। প্রকৃতির নিয়মে বছর হারিয়ে যায় মহাকালের গর্ভে। বিদায় নিলো দুই হাজার বাইশ সাল। ২০২৩ সালে পা দিলো বিশ্ব। আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-বঞ্চনা’র সাক্ষী হয়ে থাকবে বিদায়ী বছরটি। সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ এখন চলছে।
বিদায়ী বছরে সিলেটের বেশ কিছু ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো। সু-সংবাদের চেয়ে দু:সংবাদের পাল্লাই ছিলো ভারী। স্মরণকালের দুই দফা ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছে মানুষ। এমন বন্যা সিলেট অঞ্চলের মানুষ আগে দেখেনি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন উত্তপ্ত ছিলো ক্যাম্পাস। এছাড়াও বহুল আলোচিত প্রবাসী পরিবারের চার সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু, রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তেজনার পাশাপাশি বিদায়ী বছরে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এসব ঘটনা ছাড়াও খুন, ধর্ষণ ও আত্মহত্যার ঘটনায় সিলেট ছিলো গণমাধ্যমের শিরোনামে।
বন্যায় বিপর্যয় : মে মাসে প্রথম দফা বন্যার কবলে পড়ে সিলেট। এরপর ১৫ জুন দ্বিতীয় দফায় শুরু হয় বন্যা। এ সময় পুরো সিলেট বিভাগের চার জেলার অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তবে বেশি ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হন সিলেট ও সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা। এ দুটো জেলার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। দিনের পর দিন অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নেটওয়ার্কহীন কাটাতে হয়েছে। মানুষকে ভুগতে হয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে। ভেসে যায় গবাদি পশু। বানভাসি মানুষ যখন ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে এক কাপড়ে ছুটছিলেন, তখন তারা ভাবতে পারেননি, ঘরে ফেরা সহজ হবে না।
দুই দফা বন্যায় বড় সংকটে পড়ে অর্থনীতি। খাবার, সুপেয় পানি ও চিকিৎসার অভাবে বন্যায় সিলেটজুড়ে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিলো। প্রায় এক কোটি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কেউ কেউ ঘরের ভেতরে মাচা বানিয়ে থেকেছেন। তখন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিত্তবান মানুষেরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেকটাই সহজ হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
প্রবাসী ট্র্যাজেডি : ২৬ জুলাই ওসমানীনগর উপজেলার তাজপুরে শয়নকক্ষ থেকে অচেতন অবস্থায় লন্ডন প্রবাসী পরিবারের ৫ সদস্যকে উদ্ধার করে পুলিশ। ওইদিন হাসপাতালে মারা যান গৃহকর্তা রফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে মাইকুল ইসলাম। এ দুজনের মৃত্যুর ১১ দিনের মাথায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রফিকুলের মেয়ে সাদিয়া ইসলামও। তাদের মৃত্যুর কারণ খোঁজে বের করতে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এদিকে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে রফিকুলের স্ত্রী হুছনারা বেগম ও আরো এক ছেলে সাদিকুল ইসলাম বাড়ি ফিরেন। এর কয়েকদিন পর ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন রফিকুলের স্ত্রী হুছনারা বেগম। এরপর রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।
শাবি উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন : বছরের শুরুর দিকেই ১৩ জানুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্রীরা। ১৬ জানুয়ারি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছেঁড়ে। পরে এই আন্দোলন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।
আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ, অনশন, মশালমিছিল, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশনা দিলেও শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। তাঁদের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন শুরু করেন।
দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পালন করেন ২৭ শিক্ষার্থী। ২৫ জানুয়ারি শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তার স্ত্রী ইয়াসমিন হক গিয়ে দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ১১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণে আশ্বাস পাওয়ায় ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। পরে শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী উপাচার্য পুলিশি হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন।
রাজনীতিতে অস্থিরতা : ১৯ নভেম্বর বিএনপির সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশ হয়। সমাবেশ সফল করতে প্রচারণায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বাধা, মামলা ও গণগ্রেফতারের অভিযোগ করে বিএনপি। সমাবেশের আগে ছাত্রলীগ মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন করলে উত্তেজনা ছড়ায়। বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে পরিবহন ধর্মঘট আর আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি অবস্থান থাকলেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ হয়।
এদিকে বিদায়ী বছরে জামায়াতে ইসলামী সিলেটে কর্মসূচী পালন করে। তবে কয়েকটি কর্মসূচী রাজনৈতিক বাঁধার সম্মুখিন না হলেও পুলিশী বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছে। এছাড়া ডিসেম্বরে মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর, সেক্রেটারীর জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে আদালত তাদেরকে কারাগারে পাঠান। এছাড়া বছরজুড়ে অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেফতার হন।
২২ অক্টোবর সিলেট মহানগরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা-কর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, মহনগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বজনপ্রীতি করে ‘পকেট কমিটি’ তৈরি করছেন। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই সদস্যের কমিটি গঠিত হয় ২৩ অক্টোবর। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ এ কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ করে। এসব কর্মসূচি থেকে অভিযোগ করা হয়, কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি।
বিএনপি নেতা খুন : ৬ নভেম্বর রাতে আম্বরখানা বড়বাজারে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক আ.ফ.ম কামাল। পরে বিএনপি অভিযোগ তোলে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তরা কামালকে খুন করেছে।
শাবি শিক্ষার্থী খুন : ২৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাশে গাজী-কালু টিলা লাগোয়া ‘নিউজিল্যান্ড’ এলাকায় বেড়াতে গিয়ে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদ (২২)। বুলবুল হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
হোটেলে দুই তরুণীকে গণধর্ষণ : সিলেট নগরীর রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন একটি আবাসিক হোটেলে দুই তরুণীকে রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এক তরুণীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব ও পুলিশ। এরমধ্যে একজন আদালতে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গ্রেফতারকৃত আপর দুই আসামীর মধ্যে একজন জামিনে থাকলেও ধর্ষণে সহযোগিতাকারী তরুণী কারাগারে রয়েছে।
ভূমিকম্প : অন্যান্য বছরের মতো বিদায়ী বছরও সিলেটে কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রা ছিল ২১ জানুয়ারি। ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তি ছিল মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত। তবে এতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।