কম্পিউটার ব্যবসায় স্থবিরতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ৩:০৬:৫৪ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল :
সিলেটের কম্পিউটার ব্যবসা যেন শীতের মতোই জমে আছে। করোনার পর থেকেই এই ব্যবসায় কোনোরকমে করে খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে প্রায় তিনমাস ধরে অবস্থা একেবারে নড়বড়ে। এসময় কম্পিউটার বিক্রি ও মেরামত কাজের গতি অনেকটা স্থবির। অবস্থা এরকম চললে অনেক ব্যবসায়ীকেই ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে হবে। এরইমধ্যে অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে তারা বলেন সময়ের ব্যবধানে কম্পিউটার এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় একটি পণ্য হিসেবে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এর ব্যবহার এখন সর্বোচ্চ। এটি কোনো বিলাশ পণ্য নয়, তাই একে নিত্যপণ্যের আওতায় এনে বিশেষ ক্যাটাগরিতে সুবিধা প্রদানের দাবিও সরকারের প্রতি ব্যবসায়ীদের। তাছাড়া ব্যবসার প্রসারে তা বিকেন্দ্রীকরণ করাও জরুরি বলে মনে করেন তারা। এতে একদিকে যেমন ক্রেতার বিক্রয়োত্তর সেবা দ্রুত হবে তেমন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবে। মধ্যসত্ত্বভোগ কমে মফস্বল পর্যন্ত ব্যবসা সম্প্রসারণ হবে।
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শীতের সময় কম্পিউটার নষ্ট হয় কম। ফলে নতুন কম্পিউটার কেনা ও মেরামত কম হয়। তাছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে। এরমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা আগে ছিল না। ফলে এই দুই অবস্থা মিলে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্য বিক্রি কমেছে। কম্পিউটার ব্যবহারকারীরাও কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ কেনায় মিতব্যয়ী হয়ে উঠেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান আগে কম্পিউটার পণ্যের বড়ো একটা অংশের ক্রেতা ছিল সরকার। সরকারি অনেক প্রজেক্টের জন্য তা কেনা হতো। কিন্তু ইদানীং সরকারিভাবে তা কেনা হচ্ছেনা। এসব ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্টপোষকতাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কম্পিউটারের মতো একটি পণ্য যা ডিজিটাল বাংলাদেশ ও শিক্ষার প্রসারে ক্রমশ ভূমিকা রাখছে তাতে আমদানি বা উৎপাদন শুল্ক কেন করা হলো তা বোধগম্য নয় বলেও জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা বলেন কম্পিউটার ব্যবসা নিয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির পক্ষ থেকে বরাবরই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তারা বলেন দেশের সংকটকালীন সময়ে প্রযুক্তি পণ্য এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। দেশের অর্থনীতির চাকাকেও অবিরত রাখতে প্রযুক্তি পণ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রযুক্তি পণ্য কোনো বিলাসবহুল পণ্য নয়। হঠাৎ করে কম্পিউটারের ওপর শুল্ক আরোপ ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অন্তরায়।
প্রযুক্তি পণ্য অন্য আরো দশটি পণ্যের মতো সাধারণ প্রোডাক্ট নয়। এর সঙ্গে গবেষণা, পরিকল্পনা, কাঁচামালের সহজলভ্যতা এবং সমন্বয়ের ব্যাপার রয়েছে। আমরা এই খাতে কীভাবে আমদানি নির্ভরতা কমানো যায় তা নিয়ে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে ব্যাপারটি হুট করে হয়ে যাওয়ার মতো নয়। তাই নিজেদের পরিপূর্ণ সক্ষমতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত কম্পিউটার আমদানির উপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের সময় হঠাৎ করে কম্পিউটারের উপর শুল্ক যুক্ত হলে সাধারণ মানুষ প্রযুক্তি পণ্যের উপর আগ্রহ হারাবে।
তিনমাস ধরে কম্পিউটার ব্যবসার এই অবস্থা কেন জানতে চাইলে নগরীর জিন্দাবাজারের কানিজ প্লাজার কম্পিউটার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ল্যাপটপ ওয়ার্কশপের কর্ণধার প্রকৌশলী আবু সাঈদ মোহাম্মদ আলী কাওসার বলেন শীতকালে বিদ্যুতের আনা নেওয়া কম থাকে, ফলে কম্পিটার যন্ত্রাংশ কম নষ্ট হয়। তাই নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে কম্পিউটার মেরামত ও কেনাবেচা অন্য সময়ের চেয়ে কমে যায়। তাছাড়া এসময় বিভিন্ন স্কুল কলেজ বন্ধ, বাচ্চাদের ফলাফল, পরীক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ততা থাকে। তাই নতুন কম্পিউটার কেনায় অনেকেই তখন আগ্রহী থাকেন না। এসব নানান কারণে এখন ব্যবসা অনেকটাই স্লো। এর উপর করোনার একটা প্রভাব তো আগে থেকেই আছে। তাই সার্বিক দিক দেখলে কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা এখন ভালো আছেন বলা যায় না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি সিলেট শাখার চেয়ারম্যান এ এস এম জি কিবরিয়া বলেন সিলেটে আমাদের ৭২ সদস্যসহ ১৫০ জনের মতো কম্পিউটার ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠান আছে। এরবাইরেও অনেক মোবাইলের দোকানসহ বিভিন্ন ভাবে কম্পিউটার পণ্য বিক্রির সাথে অনেকেই জড়িত আছেন। বর্তমানে কারো অবস্থাই ভালো নেই। কম্পিউটারের মধ্যে এখন ল্যাপটপ বেশি বিক্রি হয়। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতিটি পণ্যের দাম ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। নতুন পণ্য আমদানি বা উৎপাদনে শুল্ক ১৫ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে। এতে আগে যে ল্যাপটপ ৪০ হাজারে কেনা যেতো তা এখন ৬০ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই এখন খুব প্রয়োজন না হলে কম্পিউটার কিনছেন না। আর যারা কিনছেন তাদের বেশিরভাগ এখন পুরাতন কম্পিউটার বা ল্যাপটপের দিকেই ঝুঁকছেন। এতে বাইরে ব্যবহারকরা ল্যাপটপ বেশি বিক্রি হচ্ছে। যা কদিন পরই ই বর্জ হিসেবে পরিণত হবে। এসব ল্যাপটপ দেশের বাইরে ব্যবহার হয়ে অবৈধ পথে আমদানি হয়। এটি বিক্রি অবৈধ না হলেও নানান চোরাই পন্থায় আমদানি হচ্ছে। এতে বৈধ কম্পিটার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এরসাথে পুরাতন এসব ল্যাপটপ কদিন পরই ই বর্জে পরিণত হওয়ায় তা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি হয়ে যাচ্ছে। কারণ একটি প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনের পর তা ব্যবহারের একটা সময়সীমা থাকে। এরপর তা ব্যবহার ক্ষতিকর। বাইরের এসব পণ্য এমনিতেই আগে থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে যারা কিনছেন তারা কিছুদিন ব্যবহারের পরই তার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তখন তা বর্জে পরিণত হয়। তাই সরকার এবং ক্রেতা উভয়কেই এটা খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে কী করণীয় জানতে চাইলে কিবরিয়া বলেন আমদানি বা উৎপাদন শুল্ক বাদ দেওয়ার জন্য আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সমিতির পক্ষ থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এর সাথে কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতিও হিসেবেও তিনি বাস্তবতা অনুধাবন করে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে শুল্ক বাদ দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের আশ^স্ত করেছেন। যদি এটা হয়ে যায় তাহলে এটি ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক সহায়ক হবে।
এছাড়াও অবৈধ আমদানি বন্ধ করতে হবে। কম্পিউটার এখন কোনো বিলাস পণ্য নয় এটি একটি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য। শিক্ষাদীক্ষায় এখন কম্পিউটার অনেকটাই অপরিহার্য। তাই একে নিত্য পণ্যের আওতায় এনে শুল্ক তুলে দিতে হবে এবং এই ব্যবসা সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিতে হবে। মফস্বলে এর প্রসার বাড়াতে বাজার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রজেক্টে কেন্দ্রীয়ভাবে কম্পিউটার পণ্য না কিনে স্থানীয়ভাবে তা কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন এবং বিক্রোয়ত্তোর সেবা দ্রুত পাওয়া যাবে। ক্রেতারা পণ্য কিনে না ঠকতে বৈধভাবে আসা পণ্য কিনতে হবে এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির ২০১৮ সালে প্রণীত ওয়ারেন্টি নীতিমালা খেয়াল করে কিনতে হবে। সরকারিভাবে কম্পিউটার পণ্য কেনা কমে গেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন এ ব্যাপারে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাই ভালো বলতে পারবেন।