ইন্টারনেট শাটডাউন কী?
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ৬:৪০:২৭ অপরাহ্ন
আজকের ডিজিটাল সমাজে, দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের ব্যবহার অপরিহার্য। ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অনলাইনে পড়াশোনা সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেট অপরিহার্য। যখন ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করা হয়, যেমনটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে সামাজিক অস্থিরতার সময়ে হয়েছে, তখন মানুষের জীবন দারুণভাবে ব্যাহত হয়।
ইন্টারনেট শাটডাউন কী এবং সরকার বা অন্য অপরাধীরা এই ব্যবস্থা নিলে কী হয়? এর সংজ্ঞা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার চেয়েও অনেক বিস্তৃত। ইন্টারনেট শাটডাউন নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে ঢোকার সুযোগ আংশিক বন্ধ করা থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের গতি সীমিত করে দেওয়া হতে পারে। শাটডাউনের বিভিন্ন ধরন এবং কীভাবে সেগুলো প্রযুক্তিগতভাবে বাস্তবায়ন করা হয় সে সম্পর্কে বোঝার বিষয়টি অধিকার-লঙ্ঘনকারী এই পদক্ষেপের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ এবং অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সুশীল সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন ধরনের ইন্টারনেট শাটডাউন, বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে এগুলো বাস্তবায়ন করা হয় এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অবাধে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সমুন্নত রাখার জন্য কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানান তা এই নিবন্ধে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কল্পিত ও ভুল ধারণা
ইন্টারনেট শাটডাউন সেটি সম্পূর্ণ বন্ধ করার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে অথবা একই ধরনের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট সেন্সরশিপের মতো ব্যবস্থাও হতে পারে।। #কববঢ়ওঃঙহ জোট থেকে জনমতের ভিত্তিতে সংগৃহীত সংজ্ঞা ইন্টারনেট শাটডাউনকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে:
[একটি] ইন্টারনেট বা ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের ইচ্ছাকৃত ব্যাঘাত, যার কারণে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় এগুলো ব্যবহারের সুযোগ থাকে না বা কার্যকরভাবে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে, যা সাধারণত তথ্যের প্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্যই করা হয়।
এই সংজ্ঞাটি দেখায় যে, শাটডাউন প্রকৃতপক্ষে সংযোগ না থাকার চেয়েও বেশি কিছু। মোবাইল সেবা ব্যাহত হওয়া, সংযোগগুলোর গতি সীমিত বা ধীর করে দেওয়া বা বেছে বেছে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়া সবই ইন্টারনেট শাটডাউন হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইন্টারনেট সেন্সরশিপ কী? ইন্টারনেট শাটডাউনকে সেন্সরশিপের একটি ধরন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে (কারণ নেটওয়ার্কে বিঘ্ন হলে তা মানুষকে অনলাইনে কনটেন্ট পোস্ট করতে বা নিজেদের প্রকাশ করতে বাধা দেয়)। তবে ইন্টারনেট সেন্সরশিপের সব দৃষ্টান্তকেই শাটডাউন হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। অ্যাক্সেস নাউ-এর মতে, পার্থক্যটি ব্লক বা বন্ধ করে দেওয়া প্ল্যাটফর্মের প্রাথমিক উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে। ওপরের সংজ্ঞাটি ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের ব্যাঘাতকে তুলে ধরে; তবে যদি হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ও টুইটারের মতো যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মগুলো ব্লক করা হয়, তাহলেও সেটাকে ইন্টারনেট শাটডাউন বলে গণ্য করা হবে। কিন্তু যখন সংবাদ ওয়েবসাইটের মতো যারা মূলত কনটেন্ট প্রকাশ করে এমন প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্লক করা হয়, তখন এগুলো ইন্টারনেট সেন্সরশিপের ধরন হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইন্টারনেট শাটডাউন করার সাধারণ যুক্তিসমূহ
সেন্সরশিপ ও তথ্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইন্টারনেট শাটডাউনের কলাকুশলীরা এই ধরনের নেটওয়ার্ক-বিঘ্ন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন। এ বিষয়ে অ্যাক্সেস নাউ-এর সাবেক পলিসি ফেলো ডেনিজ ডুরু আইডিন প্রচলিত কিছু সরকারি অজুহাতের তালিকা করেছেন:
জাতীয় নিরাপত্তা: এটি ইন্টারনেট শাটডাউনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রচলিত এবং অসার যুক্তি। বিড়ম্বনা হলো যে, মানুষ যখন তথ্য জানার সুযোগ না পায় এবং প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, তখন তারা নিরাপদ ও সুরক্ষিত বোধ করে না।
নির্বাচন: নির্বাচন-সম্পর্কিত বিভ্রান্তি ছড়ানো বন্ধ করার জন্য সরকার ইন্টারনেট শাটডাউন করে। অবশ্য বাস্তবে এ ধরনের শাটডাউন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ এবং সাংবাদিকদের ও ভোট পর্যবেক্ষকদের যোগাযোগে বাধা দেয়।
প্রতিবাদ: বিক্ষোভের সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়। তবে নেটওয়ার্কের এই বিঘ্নগুলো মানুষকে প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে বাধা দেয়।
স্কুল পরীক্ষা: প্রতারণা বন্ধ করার জন্য অনেক সময় ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়। তবে এই ধরনের শাটডাউন অল্প কয়েকজনকে লক্ষ্য করে করা হলেও তা লাখ লাখ মানুষকে প্রভাবিত করে।
সরকারি কর্মকর্তাদের পরিদর্শন: সরকারি কর্মকর্তা বা বিদেশি রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকার অনেক সময় ইন্টারনেট শাটডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা জনগণের অবাধে তথ্য পাওয়ার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সরকার এসব অজুহাত ব্যবহার করে। অ্যাক্সেস নাউ-এর এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ইন্টারনেট শাটডাউন সংক্রান্ত শীর্ষ নিয়ম ভঙ্গকারীরা এই দুই অঞ্চলে রয়েছে। ২০২১ সালে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও পাকিস্তানে ইন্টারনেট শাটডাউনের ১২৮টি ঘটনা ঘটে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
ভারত ধারাবাহিকভাবে ইন্টারনেট শাটডাউন র্যাংকিংয়ের শীর্ষে রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে দেশটিতে ইন্টারনেট শাটডাউনের অন্তত ৬৬৫টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। মিয়ানমারও এক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। সামরিক অভ্যুত্থানের পর ২০২১ সালে দেশটিতে অন্তত ১৫টি শাটডাউনের ঘটনা ঘটে। জনগণের প্রতিবাদের মধ্যে দেশটির সামরিক জান্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করার আদেশ দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে তারা আরেকটি নির্মম পদক্ষেপ নিয়েছে, তা হলো, ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ঠচঘ) ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।
ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৯ সালে বেশ কয়েক দফায় ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে বিষয়টি সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়। পশ্চিম পাপুয়ায় ২০২১ সালে একটি আদালত রায় দেন যে, সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা বৈধ ছিল। বিক্ষোভ দমন, ধর্মীয় উদ্বেগজনিত অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গুজব ও অপপ্রচার ঠেকাতে বাংলাদেশেও একাধিকবার ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়। একই ধরনের নেটওয়ার্ক ব্যাঘাতের খবর পাওয়া যায় পাকিস্তানে, বিশেষ করে দেশটির অশান্ত সীমান্ত এলাকায়। ফিলিপাইনে ২০১৫ সালে পোপের সফর এবং অন্যান্য উৎসবের সময়ে এবং শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভূত বিক্ষোভের সময়ে ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা ঘটে।
ইন্টারনেট কীভাবে কাজ করে
ইন্টারনেট শাটডাউনের প্রযুক্তিগত দিকগুলোতে যাওয়ার আগে, ইন্টারনেট কীভাবে কাজ করে তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। অক্সফোর্ড অভিধান ইন্টারনেটকে সংজ্ঞায়িত করে এভাবে:
[একটি] বৈশ্বিক কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, যা বিভিন্ন ধরনের তথ্য ও যোগাযোগ সুবিধা প্রদান করে, যা যোগাযোগের প্রমিত নিয়মনীতি ব্যবহার করে আন্তঃসংযুক্ত নেটওয়ার্কগুলোর সমন্বয়ে গঠিত।
ইন্টারনেট হল একটি রাউটারের সঙ্গে সংযুক্ত এক গুচ্ছ কম্পিউটার, যা একই ধরনের কম্পিউটারের গুচ্ছ পরিচালনাকারী অন্যান্য রাউটারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (ওঝচ) তারযুক্ত বা তারবিহীন সংযোগের মাধ্যমে এই রাউটারগুলোকে সংযুক্ত করে। প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তাদের কম্পিউটারে ওয়েব অ্যাক্সেস সফটওয়্যার (ইন্টারনেট ব্রাউজার) ব্যবহার করে সার্ভারের সঙ্গে সংযুক্ত হন। সার্ভার মূলত বিশেষায়িত কম্পিউটার, যা ওয়েবপেজ বা অ্যাপের জন্য ডেটা বা উপাত্ত জমা রাখে।
যখন কেউ তাদের ব্রাউজারে একটি ওয়েব ঠিকানা টাইপ করেন, তখন অন্তরালে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে:
ব্রাউজারটি ডোমেইন নেম সিস্টেম (উঘঝ) সার্ভারে যোগাযোগ করে এবং ওয়েবসাইটটি যে সার্ভারে রয়েছে সেই সার্ভারের ইন্টারনেট প্রোটোকল (ওচ) ঠিকানা খুঁজে বের করে।
এখন যেহেতু ব্রাউজারটি ওয়েবসাইটের প্রকৃত অবস্থান জানে, এটি সার্ভারে একটি হাইপারটেক্সট ট্রান্সফার প্রোটোকল (ঐঞঞচ) বার্তা পাঠিয়ে ক্লায়েন্ট বা গ্রাহক যে তথ্য খুঁজছেন তা গ্রাহককে পাঠাতে বলে। এই বার্তা এবং ক্লায়েন্ট ও সার্ভারের মধ্যে প্রেরিত অন্যান্য সমস্ত ডেটা ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল প্রোটোকল (ঞঈচ)/আইপি ব্যবহার করে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে পাঠানো হয়।
সার্ভার এরপর একটি “২০০ ঙক” বার্তা পাঠায় এবং ওয়েবসাইটের ফাইলগুলোকে ডেটা প্যাকেট নামক ছোট খণ্ডের একটি সিরিজ হিসেবে ব্রাউজারে পাঠায়৷
ব্রাউজার সমস্ত ডাটা প্যাকেট একত্রিত করে একটি সম্পূর্ণ ওয়েবপেজে ব্যবহারকারীর জন্য প্রদর্শন করে।
এখানে চিত্রিত হয়েছে যে, একটি ওয়েবসাইট ব্যবহার করার সময় অনেক উপাদান জড়িত থাকে। যখন একটি ইন্টারনেট শাটডাউন ঘটে, তখন এই উপাদানগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে লক্ষ্যে পরিণত করা হয়। নেটওয়ার্কের কোন পয়েন্টে ইন্টারনেট শাটডাউন ঘটেছে এবং কীভাবে এটি কার্যকর করা হয়েছিল তা বের করার জন্য ইন্টারনেটের কাঠামো এবং এটি কীভাবে কাজ করে তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।
কীভাবে ইন্টারনেট শাটডাউন প্রযুক্তিগতভাবে কার্যকর করা হয়
ইন্টারনেট কীভাবে কাজ করে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে দেখা যায়, অনেকগুলো উপাদান মিলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের অবকাঠামো তৈরি হয়। নেটওয়ার্কের বিভিন্ন পয়েন্টে ইন্টারনেট শাটডাউন কার্যকর করা যেতে পারে। ইন্টারনেট শাটডাউন নিয়ে গবেষণাকারী অ্যাক্সেস নাউ, জিগস’ ও অন্য সংস্থাগুলো নিম্নলিখিত পয়েন্টগুলোকে শাটডাউন কার্যকর করার সবচেয়ে প্রচলিত পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে:
আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যাকবোন: সমুদ্রের নিচে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল সংযোগ উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করে। এই নেটওয়ার্ক পয়েন্টে কোনো ক্ষতি বা ব্যাঘাত ঘটলে সংশ্লিষ্ট দেশের সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও ইন্টারনেট সেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইন্টারনেট গেটওয়ে: এটি একটি দেশের ইন্টারনেট সংযোগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এটি আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ট্রাফিককে স্থানীয় নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
জাতীয় এবং স্থানীয় ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী: আইএসপি নির্দিষ্ট এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করে। যদি এই পয়েন্টে ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত সব ব্যবহারকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সিঙ্গেল স্পট (একক সেলফোন টাওয়ার বা নির্দিষ্ট ছোট এলাকা): এই স্তরে নেটওয়ার্ক ব্যাঘাতের ফলে একটি খুব সুনির্দিষ্ট এলাকায় শাটডাউন ঘটে। এতে শুধু ওই নির্দিষ্ট সেলফোন টাওয়ারের গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
কীভাবে দুর্বৃত্তরা ইন্টারনেট শাটডাউন কার্যকর করে? ইন্টারনেটের জন্য একটি “চালু” এবং “বন্ধ” সুইচ আছে কি?
যখন সরকার ইন্টারনেট অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে (রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেবা প্রদানকারীদের মাধ্যমে), তখন এটি অন্য পক্ষের মাধ্যমে না গিয়ে নিজেরাই ইন্টারনেট ব্যবহার সীমিত করতে পারে। অন্যথায় তারা আইএসপিকে নেটওয়ার্ক সংযোগ সীমিত করতে বা নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ব্লক করার নির্দেশ দেয়। নেটওয়ার্ক ব্যাঘাতের লক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে, আইএসপি নিচে তালিকাভুক্ত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি ব্যবহার করে:
মৌলিক অবকাঠামো শাটডাউন: ইন্টারনেট সেবার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ অবকাঠামোর অকার্যকারিতা বা ক্ষতির কারণে এই ধরনের ইন্টারনেট শাটডাউন হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একটি পাওয়ার গ্রিড বা সেলফোন টাওয়ারের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
রাউটিং: গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে (উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে) গন্তব্যের তথ্য পরিবর্তন করার মাধ্যমে নেটওয়ার্কের নিয়মিত কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটানো, যাতে করে নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিক ব্লক বা অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকে এবং নিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো ভেতর দিয়ে অতিক্রম করতে না পারে।
ডিএনএস ম্যানিউপুলেট করা: ডিএনএস হলো একটি নামকরণ ব্যবস্থা, যা মানুষের-পাঠযোগ্য ডোমেন নামগুলো (যেমন মড়ড়মষব.পড়স) মেশিন-পাঠযোগ্য আইপি ঠিকানায় (যেমন ১৪২.২৫১.৩২.৪৬) সংরক্ষণ করে। ডিএনএস তথ্য ম্যানিউপুলেট বা নিজের প্রয়োজনমত পরিবর্তন করা হলে তা শাটডাউনের কারণ হতে পারে। এটি ঘটে যখন ব্যবহারকারীদের একটি অস্তিত্বহীন সার্ভারে বা অসৎ উদ্দেশ্যধারী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রিত সার্ভারে পাঠাতে ডিএনএস তথ্য ম্যানিউপুলেট করা হয়।
ফিল্টারিং: এই ধরনের শাটডাউনে ইন্টারনেট সেবায় প্রবেশাধিকার বন্ধে বাণিজ্যিক ফিল্টারিং যন্ত্রপাতি ও ট্রান্সপারেন্ট প্রক্সি ডিভাইস ব্যবহার হয়। এসব ফিল্টারিং ডিভাইস নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিক থেকে মেটাডেটা বিশ্লেষণ করে এবং তারপর সেই মেটাডেটার ওপর ভিত্তি করে ইন্টারনেট পরিষেবায় প্রবেশের অনুমতি দেয় বা প্রবেশাধিকার বন্ধ করে।
গতি সীমিত করা: এই ধরনের শাটডাউনে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ডেটা প্রবাহ সীমিত থাকে; কিন্তু সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয় না। পরিষেবা বা পদ্ধতি কার্যকরভাবে অব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য ইন্টারনেট বা নির্দিষ্ট পরিষেবায় প্রবেশাধিকার ধীরগতি হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, মোবাইল ইন্টারনেটকে টুজি-তে নামিয়ে দিয়ে বা ডেটার গতি নিয়ন্ত্রণ করে ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়।
ডিপ প্যাকেট বিশ্লেষণ: এই ধরনের শাটডাউনে নেটওয়ার্ক ডেটা বিশ্লেষণ ও বাছাই করা হয়। যদি ডেটা প্যাকেটটি শাটডাউনের কলাকুশলীদের নির্ধারণ করে দেওয়া মানদণ্ডের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়, তবে ডেটা প্যাকেটটিকে বিশ্লেষণ পয়েন্টের মধ্য দিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হয়।
ডিনায়াল অব সার্ভিস (উড়ঝ): এই আক্রমণের উদ্দেশ্য হলো একটি মেশিন বা নেটওয়ার্ক বন্ধ করা, যার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ওই মেশিন বা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারেন না। যে প্ল্যাটফর্ম বা সার্ভারকে লক্ষ্য করে এই আক্রমণ চালানো হয় সেই প্ল্যাটফর্ম বা সার্ভারকে ব্যস্ত রাখতে এবং ব্যবহারকারীদের ডেটা প্রদান থেকে বিরত রাখতে সেখানে নকল ব্যবহারকারী পাঠানো হয়।
ইন্টারনেট শাটডাউন বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো
বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের দল বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট শাটডাউন শনাক্ত ও পর্যবেক্ষণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে ওপেন অবজারভেটরি অব নেটওয়ার্ক ইন্টারফিয়ারেন্স (ঙঙঘও), যা ওয়েবসাইট ব্লকের বিষয়টি গণনা করার জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছে এবং ঙঙঘও এক্সপ্লোরারে এই ডেটা প্রকাশ করে। দ্য ইন্টারনেট আউটেজ ডিটেকশন অ্যান্ড অ্যানালাইসিস (ওঙউঅ) প্রকল্প নেটওয়ার্কের প্রান্তকে প্রভাবিত করে এমন দৃশ্যমান ইন্টারনেট বিভ্রাট শনাক্ত করতে ইন্টারনেট পর্যবেক্ষণ করে। অন্যদিকে সেন্সরড প্ল্যানেট সেন্সরশিপের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নির্ধারণ করতে ২০০টিরও বেশি দেশে ডেটা সংগ্রহ করে। গুগল তার ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্টের মাধ্যমে নিজের পণ্যগুলোতে ব্যবহারকারী ট্র্যাফিক সম্পর্কে ডেটা প্রকাশ করে, যেখানে প্রতিমুহূর্তে প্রবেশাধিকার বাধাপ্রাপ্তির ঘটনা নথিভুক্ত থাকে, যা শাটডাউন নির্দেশ করে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা নথিভুক্ত করার জন্য বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদন ও পদ্ধতি প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলো প্রকাশ করেছে ওওএনআই, অ্যাক্সেস নাউ ও এনগেজমিডিয়ার মতো পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান।
জনসচেতনতা বাড়াতে এবং এসব অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগে ইন্টারনেট শাটডাউন পর্যবেক্ষণ এবং এ সংক্রান্ত তথ্য নথিভুক্ত করার এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এসব দেশের সরকার জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার কথা উল্লেখ করে ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনাগুলোর পক্ষে সাফাই গায়। তবে এই বিস্তৃত ব্যবস্থাগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করে, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের কাজ করতে বাধা দেয় এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও এর অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা নথিভুক্ত করা এবং বাধাদানের বিষয়ে জনসাধারণের জ্ঞান ও সচেতনতা বাড়ানো এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়ে অভিযোগ করার মাধ্যমে, ডিজিটাল অধিকারের পক্ষাবলম্বনকারী ও সুশীল সমাজ ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের এই রূপকে প্রতিহত করার চলমান প্রচেষ্টাকে আরও কার্যকরভাবে শক্তিশালী করতে পারে।
*গ্রেটার ইন্টারনেট ফ্রিডম প্রোগ্রাম-এর আওতায় এনগেজমিডিয়া কর্তৃক এই ব্লগ পোস্টটি তৈরি করা হয়েছে।