জৈন্তার গোলমরিচে সম্ভাবনার হাতছানি
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ৯:০৪:২২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: গোলমরিচ আমাদের পরিচিত একটি মশলাজাত পণ্য। অনেকেই রান্নায় ঝাল বাড়াতে গুলমরিচ ব্যবহার করেন। তবে রান্নার বাইরে এর রয়েছে অসাধারণ সব ঔষধি গুণাগুণ। আর এই গুণাগুণের কারণেই দেশে গোলমরিচ চাষ গুরুত্ব পাচ্ছে। এসময় সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে শুধু নিজেদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন বাড়িতে গোলমরিচের গাছ লাগানো হতো। তবে সম্প্রতি এর বাণিজ্যিক উৎপাদন নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে পানের সাথে গোলমরিচ চাষের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে বলে দেখছেন গবেষকরা। এ নিয়ে জৈন্তাপুরের খাসিয়া পুঞ্জিগুলো কিছু কাজও চলছে বলে জানা গেছে।
ষাটের দশকে বাংলাদেশে গোলমরিচের চাষাবাদ প্রবর্তিত হয়। তখন সিলেট অঞ্চলে বসতবাড়িতে কিছু গাছ ছিল। ১৯৮৭ সালে নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট জৈন্তিয়া গোলমরিচ-১ জাতটি উদ্ভাবন করে। যা বারি গোলমরিচ নামে পরিচিত। সেই থেকে শুরু হয়ে আজও অব্যহত আছে গোলমরিচ নিয়ে গবেষণা।
গবেষকদের মতে গোলমরিচের অনেক ঔষধি গুণ রয়েছে। এরমধ্যে এটি কফ, ঠাণ্ডা জনিত সমস্যা নিরাময় করে; ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ব্যাহত করে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে; গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করে; ওজন কমাতে সাহায্য করে; কোমর বা পাঁজরের ব্যথা সারাতে গোলমরিচ চূর্ণ গরম পানিসহ সকাল ও বিকালে একবার করে খাওয়া যায় তাছাড়া গোলমরিচ সামান্য পানিসহ বেটে দাঁত ও মাড়িতে প্রলেপ দিলে ব্যথা দূর হয়।
এ ব্যাপারে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, গোলমরিচ মূলত গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোয় ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয়। এটি বহুবর্ষজীবী লতাজাতীয় উদ্ভিদ। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ব্রাজিল, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য গ্রীষ্মপ্রধান দেশে গোলমরিচ বেশি চাষ করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় স্বল্প পরিসরে গোলমরিচের চাষ হচ্ছে। দেশে বর্তমান গোলমরিচের চাষ নিয়ে চলছে নানান গবেষণা। এরই অংশ হিসেবে সিলেট অঞ্চলের পাহাড় ও টিলাগুলোয়ও গবেষণা চলছে।
পাহাড়ি এলাকায় গোলমরিচ চাষের জন্য শুষ্ক মৌসুমে পানি ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন গবেষক সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রায় সাত-আট মাস গোলমরিচ গাছে ফল থাকে, ফলে গাছ থাকে শারীরিকভাবে দুূর্বল। সঠিক পরিচর্যা ও পুষ্টি উপাদান সরবরাহের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই দূর করা সম্ভব।’
তিনি জানান, সিলেট অঞ্চলে চাষ হওয়া গোলমরিচের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, যে গাছগুলোয় কোনো ধরনের ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়নি, সেগুলোয় তুলনামূলক ফুল ও ফলের পরিমাণ কম। এমনকি তাদের ফলের আকৃতিও ছোটো ছিল। আবার পানি ও সারের পাশাপাশি একটু যত্ন নেওয়া গাছগুলোয় ফলের সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে। এমনকি সেগুলোর আকৃতিও বেশ বড়ো ছিল, যা আসলেই সম্ভাবনাময়।
গোলমরিচ গবেষক সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামিউল আহসান তালুকদার বলেন, গোলমরিচ একটি লাভজনক ফসল। পানের মতো প্রতিদিন বা সপ্তাহ শেষে বিক্রির সুযোগ না থাকলেও বছর শেষে শুকনো গোলমরিচ বিক্রি করে কৃষক মোটা অংকের টাকা পাবেন। যা কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। সিলেট অঞ্চলে এর বাণিজ্যিক চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে সে সুযোগকে কাজে লাগানো যেতে পারে। রান্না ছাড়াও গোলমরিচের ঔষধি ব্যবহার নিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
মেদ ঝরাতে: গোলমরিচের খোসা মেদ ঝরাতে সাহায্য করে। তাই যদি নিয়মিত গোলমরিচ দিয়ে খাবার বানানো এবং সেটা খাওয়া হয় তাহলে মেদ খুব দ্রুত ঝরে যাবে।
হজমশক্তি বাড়ায়: অনেকেই হজমের সমস্যায় ভোগেন। তাঁরা খাবারে গোলমরিচ ব্যবহার করে দেখতে পারেন। দারুন উপকার পাবেন। গোলমরিচ আমাদের হজম শক্তি বাড়ায়। একই সঙ্গে ডায়রিয়া অথবা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলেও সেটা দূর করে দেয় গোলমরিচ। তাই হজমের সমস্যা বা পেটের সমস্যা থেকে যে একাধিক রোগ আমাদের দেহে থাবা বসায় সেগুলো থেকে গোলমরিচ আমাদের রা করে।
ধূমপান: ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য তিকর’। কিন্তু অনেকেই চেয়েও ত্যাগ করতে পারেন না ধূমপানের নেশা। গোলমরিচ দিয়ে তৈরি তেলের গন্ধ সেবন করুন রোজ। এতেই কমবে ধূমপানের নেশা।
দাঁতের ব্যথা: ক্যাভিটির কারণে অনেকেই দাঁতের ব্যথায় ভোগেন। গোলমরিচ মুখে রাখলে এই ব্যথা দূর হবে।
ক্যান্সার হলে: গোলমরিচ ক্যান্সারের কোষকে ধ্বংস করে কারণ এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
স্মৃতিধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায়: গোলমরিচ স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে। মস্তিষ্ক সচল রাখতে সাহায্য করে। তাই এটা খেলে ভুলে যাওয়া বা অ্যালজাইমার্সের হাত থেকে রা পাওয়া যায়।
ডায়াবিটিস: ডায়াবিটিস রোগের জন্যও গোলমরিচ ভীষণই উপকারী। এটা রক্তের সুগার লেভেলকে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া কেউ যদি নাক বন্ধ হওয়া, হাঁপানিতে ভোগেন তাহলেও গোলমরিচ উপকার দেবে। গলা ব্যথা কমাতে গরম পানিতে এক টেবিল চামচ গোলমরিচ এবং দুই চামচ মধু মিশিয়ে খেলে ব্যথা কমে যায়। এসব নানান দিক বিবেচনায় গোলমরিচ কেবল রান্নায় নয় ঔষদি দিক বিবেচনায় বাণিজ্যিকভাবেও চাষ করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।