৩ মাসে ৮৮ শতাংশ কম বৃষ্টি: বোরো’র ফলন নিয়ে শঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১:০০:৩১ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি। ৩ মাসের গড় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৮ শতাংশ কম। এতে বোরো’র ফলন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ফেব্রুয়ারি-মার্চেও অনাবৃষ্টি-খরার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। মাঘ মাসেই চৈত্রের খরতাপের চিত্র। ভরা বর্ষা মৌসুমে অপ্রতুল বৃষ্টি হওয়ায় নদ-নদী খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে।
আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ কমিটির পর্যালোচনার তথ্য অনুযায়ী, বিগত নভেম্বর মাসে দেশে মৌসুমের ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টির তুলনায় গড়ে ৯৮ শতাংশই কম, ডিসেম্বরে ৬৬.৬ শতাংশ কম এবং গেল জানুয়ারি মাসে একশ’ ভাগই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অর্থাৎ টানা ৩ মাসে গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৮ দশমিক ২ ভাগই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। বলা যায়, বাস্তবে বৃষ্টিই ঝরেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে এহেন বিরূপ হয়ে উঠেছে আবহাওয়া-প্রকৃতি। প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের অভাবে সামনে বোরো’র ফসলের ফলন নিয়ে শঙ্কিত কৃষক।
জানা গেছে, টানা অনাবৃষ্টির ফলে ভূগর্ভস্থ পানির পর্যাপ্ত রিচার্জ হয়নি। আর ভূ-উপরিভাগের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওড়, জলাশয়সহ পানির উৎসগুলো অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে খুব দ্রুত। আবার, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় এখন মাঘ মাস অতিক্রম না করতেই চৈত্রের মতো খরতাপ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় এবার দেশজুড়ে আগেভাগেই খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যা দেশে চৈত্র-বৈশাখে দৃশ্যমান হয়ে থাকে।
কৃষি ও কৃষি-আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনাবৃষ্টি বা আগাম খরা দশার বিরূপ প্রভাবে ফল-ফসল, ক্ষেত-খামার, মাছ চাষসহ গোটা কৃষি-খামার সেক্টর সঙ্কটের মুখে পড়েছে। পানির অভাবে বোরো বীজতলা আবাদ ব্যাহত হয়েছে। ফলের বাগান শুকিয়ে ও রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। চাষাবাদে ভূ-উপরিভাগের ‘স্বাভাবিক’ পানিটুকু মিলছে না অনেক এলাকায়। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের উপর নির্ভরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে পানি সেচে কৃষকের খরচও বেড়েই চলেছে। সেই সাথে চাষাবাদে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গেল ভরা বর্ষা মৌসুমে বিগত জুলাই মাসে দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় গড়ে ৫৭.৬ শতাংশ এবং আগস্ট মাসে ৩৬.৪ শতাংশ ঘাটতি ছিল বৃষ্টিপাতে। গত বর্ষাকালে অঞ্চলভেদে বৃষ্টিপাতেও ছিল ব্যাপক অসঙ্গতি। এদিকে গত বৃহস্পতিবার আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মাঘ-ফাল্গুন মাসেও দেশে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হতে পারে। একই ধরনের অনাবৃষ্টির আভাস রয়েছে মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসেও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি এই তিন মাসে ধারাবাহিকভাবেই বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে খুবই কম হয়েছে। এই অনাবৃষ্টির কারণে কৃষির সবক্ষেত্রেই পড়েছে বিরূপ ও বৈরী প্রভাব। ধান, গম, পাটসহ সবরকম ফল-ফসলে সম্পূরক সেচ দিতে হচ্ছে। এরজন্য কৃষককে অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ব্যয় বেড়ে গেছে কৃষকের। জমিতে সেচ না দিলে ফল ও ফসল দুর্বল, রোগাক্রান্ত হচ্ছে। গাছ মারা যাচ্ছে। দেশের কৃষিঅঞ্চলে প্রতিঘণ্টায় ‘বোরিং’ পদ্ধতিতে সেচের খরচ পড়ছে ২শ’ টাকারও বেশি। একেকটি আম বাগানে পানি সেচ দিয়েই গাছ ও মাটি সতেজ রাখতে হচ্ছে। পানির অভাব পূরণের জন্য মাছের পুকুর-জলাশয়ে সারাক্ষণ পানি দিতে হচ্ছে। অত্যধিক হারে পানি উত্তোলন, অন্যদিকে অনাবৃষ্টি-খরা দশার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারী) আবহাওয়া অধিদফতরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় ফেব্রুয়ারি মাসের উক্ত দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান।
সভায় জানানো হয়েছে, চলতি ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মাঘ-ফাল্গুন মাসে সামগ্রিকভাবে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ মাসের প্রধমার্ধে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এক থেকে ২টি মৃদু (সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে মাঝারি (৬ থেকে ৮ ডিগ্রি) ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে। এ মাসের প্রথমার্ধে দেশের নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি কুয়াশা থাকতে পারে। এ মাসে দেশের কোথাও কোথাও এক থেকে ২দিন শিলাবৃষ্টিসহ বজ্রঝড় সংঘটিত হতে পারে।
এ বিষয়ে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারী এই ৩ মাসে সিলেটে স্বাভাবিকভাবে ৪৯ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। অথচ গত ৩ মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার। আর সবটুকু হয়েছে নভেম্বরে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারীতে সিলেটে কোন বৃষ্টি হয়নি।
তিনি জানান, নভেম্বর মাসে স্বাভাবিকভাবে ৩০ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে ২৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার। ডিসেম্বর মাসে ৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। একদিন হালকা বৃষ্টিপাত হয়েছে ঠিক তবে তা কাউন্ট করার মতো ছিলনা। জানুয়ারী মাসে ৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও কোন বৃষ্টিপাত হয়নি।