নির্মাণসামগ্রীর দাম আকাশ ছোঁয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১:০০:১৭ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : জীবন পরিচালনার প্রতিটিক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে বাড়ছে ব্যয় বাড়ছেই। এ থেকে ব্যতিক্রম নয় নির্মাণশিল্প। জ¦ালানী তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে গত এক বছরে নির্মাণশিল্পের অপরিহার্য উপকরণ রডের দাম ভেঙেছে অতীতের সব রেকর্ড। সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে সিমেন্ট। দাম বাড়ার রেকর্ড গড়েছে ইট, বালু, ভরাট বালু, পাথরও। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নির্মাণে জড়িত শ্রমিকের খরচও।
নির্মাণসামগ্রীর এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে আবাসন প্রকল্পগুলোতে। কনস্ট্রাকশন খরচ বাড়ায় বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ফ্ল্যাট। ফলে ফ্ল্যাট নামক আবাসনটি ক্রমশই মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চাপ পড়েছে বাড়ি ভাড়ায়। সবমিলিয়ে থমকে যাচ্ছে জীবন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্মাণ খরচ বাড়ায় দাম বেড়েছে সব ধরনের ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের। বর্ধিত দামের কারণে গত বছর বিক্রি নেমে আসে অর্ধেকে। যদিও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলে আবারও ফ্ল্যাটের দাম কমে আসবে। তবে চলমান বা শেষ পর্যায়ের প্রকল্পের ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট বর্ধিত দামেই বিক্রি হবে। মূলত খরচের সঙ্গে সমন্বয় করেই এ দরে তারা বিক্রি করছেন।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের এক তথ্য বলছে, দুই বছরের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। ২০২০ সালে এক টন রড ছিল ৬৪ হাজার টাকা, ২০২১ সালে ৬ হাজার টাকা বেড়ে হয় ৭০ হাজার টাকা। আর ২০২২ সালে কয়েক ধাপে ২৪ হাজার টাকা বেড়ে সর্বোচ্চ ৯৪ হাজার টাকায় ঠেকে।
একইভাবে বেড়েছে সিমেন্ট, বালু, পাথর, ইট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, গ্রিল ও রেলিং, জেনারেল ইলেকট্রিফিকেশন, স্যানিটেশন, টাইলস ও শ্রমিক খরচ। এতে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটে বেড়েছে ৫৪১ টাকা ৩৮ পয়সা।
দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনের ক্ষেত্রে এর মধ্যে শুধু রডের দাম বাড়ার কারণে ফ্ল্যাটের প্রতি স্কয়ার ফুটে নির্মাণখরচ বেড়েছে ১২০ টাকা। একইভাবে সিমেন্টের কারণে ৪৪ টাকা, বালুর কারণে ২৩ টাকা, ইটের কারণে ৪০ টাকা, পাথরের কারণে ৬৭ টাকা ৫০ পয়সা, থাই অ্যালুমিনিয়ামের কারণে ৩৫ টাকা, শ্রমিক খরচের কারণে বেড়েছে ৭০ টাকা পর্যন্ত।
দুই বছর আগে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট পাওয়া যেত ৩৭৫ থেকে ৪০৫ টাকায়, ২০২১ সালে ছিল ৩৯০ থেকে ৪২৫ টাকা। যেটা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭৫ থেকে ৫৬০ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট বেড়েছে ৮৫ থেকে ১৩৫ টাকা। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে দাম বেড়েছিল ১৫ থেকে ২০ টাকা। যেটা এর পরের বছর সর্বোচ্চ ১৩৫ টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।
দাম বেড়েছে বিভিন্ন (লাল, সাদা ও ভরাট বালু) বালুর। এক বছরে লাল ও সাদা বালুর দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ভরাট বালুর দামও এক লাফে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, এক বছরে শুধু পাথরের দাম ফুটপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে।
সিলেটে বিভিন্ন ধরনের বালু সিএফটি বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৮ টাকা। এদিকে এলসির পাথর সিএফটি বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা। যা ৩ মাসে আগেও ১৫০ টাকা সিএফটি বিক্রি হয়েছে। ভোলাগঞ্জের স্থানীয় পাথরের মধ্যে ভুতু ভাঙ্গা ১৭৫ টাকা এবং বল্ডার ভাঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ টাকা সিএফটি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত ২ বছরে বালু পাথরের দাম সিএফটি প্রতি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। পাথরের দামও বেড়েছে ৫০ শতাংশ। ডলার সঙ্কটের কারণে এলসি সংক্রান্ত জটিলতা থাকায় আমদানী করা পাথরের দাম বেড়েছে বেশী। ৩ মাসে সিএফটি বেড়েছে ৩৫ টাকা।
১ বছরে ইটের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত। ২ বছর আগে একটি ইটের দাম ছিল ৬ থেকে ৮ টাকা, পরের বছর ২০২১-এ হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। আর সদ্য বিদায়ী ২০২২ সালে সেখানে আরও ৩/৪ টাকা বেড়ে হয় সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। ইটের দাম বাড়ায় ১ বছরের ব্যবধানে স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে ৪০ টাকা।
দুই বছরে থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম বেড়েছে ১৭০ টাকা পর্যন্ত। শুধু থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম বেড়ে যাওয়ায় ২০২২ সালে ফ্ল্যাটের দাম প্রতি স্কয়ারে বাড়ে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। থাই অ্যালুমিনিয়ামের দাম দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুট ছিল ২৫০ টাকা, ২০২১ সালে ২৮০ এবং পরের বছরে তা ১৪০ টাকা বেড়ে হয় ৪২০ টাকা। দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনে ২০২২ সালে প্রতি স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে ৩৫ টাকা।
গ্রিল ও রেলিংয়ের দামও বেড়েছে ৫৫ টাকা পর্যন্ত। ২০২০ সালে গ্রিল ও রেলিংয়ের স্কয়ার ফুটের দাম ছিল ১০৫ টাকা, ২০২১ সালে ছিল ১২০ টাকা আর ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬০ টাকা। গ্রিল ও রেলিংয়ের দাম বাড়ার কারণে দুই হাজার ফুট কনস্ট্রাকশনে প্রতি স্কয়ার ফুটে খরচ বেড়েছে সাড়ে ৭ টাকা।
জেনারেল ইলেকট্রিফিকেশনের দামও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুটের (এল.এস) দাম ছিল ১০০ টাকা, পরের বছর ১০ টাকা বেড়ে হয় ১১০ টাকা এবং ২০২২ সালে তা ৪০ টাকা বেড়ে দাম হয় ১৫০ টাকা।
স্যানিটারি পণ্যের দামও বেড়েছে। দুই বছর আগে স্যানিটেশনে প্রতি স্কয়ার ফুটের (এল.এস) দাম ছিল ১০০ টাকা, পরের বছর ২০২১ সালে ১২০ টাকা এবং পরের বছর ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ১৫০ টাকা। স্যানিটেশনের কারণে নির্মাণ খরচ বেড়েছে ৩০ টাকা পর্যন্ত।
শ্রমিকের মূল্যও বেড়েছে। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুটের জন্য শ্রমিক খরচ হতো ১৪০ টাকা, ২০২১ সালে সেটা হয় ১৬০ টাকা। এর পরের বছর প্রতি স্কয়ার ফুটে শ্রমিক খরচ ৭০ টাকা বেড়ে হয় ২৩০ টাকা। শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় দুই হাজার স্কয়ার ফুট ফ্ল্যাটের কনস্ট্রাকশনের জন্য বাড়তি খরচ হয় প্রতি স্কয়ার ফুটে ৭০ টাকা। সব মিলিয়ে দুই হাজার স্কয়ার ফুটে কনস্ট্রাকশন এরিয়ায় খরচ বেড়েছে প্রতি স্কয়ার ফুটে ৫৪১ টাকা ৩৮ পয়সা।
নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন ফ্ল্যাট মালিকরা। এতে সংকটে ভাড়াটিয়ারা। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে সব শ্রেণির মানুষ বিপাকে। উল্লেখযোগ্য হারে তাদের আয় বাড়েনি। এ কারণে সংসার চালাতে হচ্ছে খরচ কাটছাঁট করে। সিলেট নগরীতে যাদের আয় ২০ হাজার টাকার মধ্যে তারা সংসার চালাতে এখন কলোনীতে থাকছেন। আর ৩০ হাজারের মধ্যে আয় হলে তাদের ভরসা এখন ১০ হাজার টাকার মধ্যে সাবলেট। বাড়তি খরচ থেকে বাঁচতে অনেকেই পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে ব্যাচেলর জীবন-যাপন করছেন। অনেকেই আবার বড় সাইজের ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন ছোট ফ্ল্যাট বা কলোনী টাইপের ছোট বাসা।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, ২০২০ সাল থেকে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে। ২০২২-এর বছরজুড়েই দাম ছিল বেশি। এতে আবাসন ব্যবসায় শঙ্কাও তৈরি হয়। ফ্ল্যাট বিক্রি কমে যায়। সদ্য বিদায়ী বছর ব্যবসাবান্ধব হয়নি। নতুন ড্যাপের কারণে আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন কঠিন হয়ে যাবে আগামীতে। এসব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।