মুরগির দামে ডাবল সেঞ্চুরী!
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:১০:২০ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্র্টার : সিলেটে ডিম-মুরগির বাজারে অস্থিরতা থামছেই না। ইতোমধ্যে ডাবল সেঞ্চুরী অর্থাৎ দুইশ টাকা অতিক্রম করেছে ব্রয়লার মুরগির কেজি। এদিকে ব্রয়লার মুরগি আর ফার্মের ডিমের বাজার অস্থিতিশীলতার জন্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের উদাসিনতায় কর্পোরেট পোল্ট্রি প্রতিষ্ঠানগুলো সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার থেকে প্রায় দু’শ’ ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ প্রান্তিক খামারিদের। শবেবরাত ও রোজাকে সামনে রেখে ডিম-মুরগির দাম আরো বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে বলেও জানিয়েছে ছোট খামারিরা।
সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ আমিষের চাহিদা মেটাতে নির্ভর করে ব্রয়লার মুরগি আর ডিমের ওপর। কিন্তু দফায় দফায় ডিম আর ব্রয়লারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাও এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে দাম বাড়তে শুরু করে। সপ্তাহ ব্যবধানে ডিমের ডজন ১৫ থেকে ২০ টাকা, আর মুরগি কেজিতে ৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
প্রান্তিক খামারিদের দাবি, কর্পোরেট পোল্ট্রি প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে ডিম ও মুরগির বাজার আরো অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। তাদের অভিযোগ, হাতেগোনা কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান সরকারি দপ্তরের সহায়তায় সিন্ডিকেট বাণিজ্য করছে।
খামারিদের হিসাবে, বাজার কপোর্রেট সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাওয়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার প্রান্তিক পোল্ট্রি ফার্মের মধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে লাখেরও অধিক। সরকারি হিসাবে টিকে আছে ৮৪ হাজার। শুধু কর্পোরেট নয়, প্রান্তিক খামারিদের প্রণোদনা না দিলে বিদেশ থেকে আমদানি করেও মুরগির মাংস ও ডিমের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না বলেও জানান খামারিরা। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরকে আরো তৎপর হবার তাগিদও দেন প্রান্তিক খামারের নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সাধারণ মানুষ যখন ডিম-মুরগির মাংসের দিকে ঝুঁকছেন, ঠিক তখনই একটি অসাধু চক্র সাধারণ মানুষের পকেট কাটতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই অসাধু চক্রটি সিন্ডিকেট করে ছোট মাঝারি খামারগুলোর উৎপাদিত ডিম, মাংসের বাজার নিয়ন্ত্রণের কৌশল হাতে নিয়েছে। ফলে প্রান্তিক খামারিরা ডিম ও মাংসের দাম কম পাচ্ছেন, অন্যদিকে ভোক্তাদের চড়া দামে ডিম-মুরগি কিনতে হচ্ছে। পাশাপাশি সিন্ডিকেটের কবলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দেশের পোল্ট্রি শিল্প।
শুক্রবার সিলেট নগরীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে ১ কেজি ব্রয়লার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩২০ টাকা, লাল মুরগি ৩০০ টাকা দরে। এছাড়া লাল ডিমের দাম ডজন প্রতি-১৪০ টাকা, সাদা ডিমের ডজন-১৩৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সুমন হাওলাদার বলেন, এখন তো ভোক্তারা ব্রয়লার মুরগি ২০০-২২০ টাকা কেজি ধরে খাচ্ছেন। বাজার মনিটরিং না হলেু আগামীতে এ মুরগি ৩০০ টাকা কেজি ছাড়িয়ে যাবে। যদি আমাদের খামারি ভাইদেরকে টিকিয়ে না রাখা যায়। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে বৃহত্তর পোল্ট্রি শিল্প জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই, ডিম-মুরগি ও টোটাল পোল্ট্রি বাজারকে তারা নিয়ন্ত্রণ করবে।
তিনি বলেন, পোল্ট্রি খাত ধ্বংসের পেছনে দায়ী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। কারণ, খামারিদের যত সুযোগ সুবিধা বলেন এগুলো কিছুই তারা করছেন না। ফলে লোকসানে থাকা খামারিরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। কর্মকর্তারা জানেই না তার উপজেলায় কতগুলো পোল্ট্রি খামার আছে, কতগুলো ব্রয়লার মুরগির খামার আছে, কতগুলো লেয়ার মুরগির খামার আছে। প্রান্তিক খামারিদের সাথে তাদের কোনো প্রকার যোগাযোগ নাই। একমাত্র কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সাথে তাদের সংযোগ।
সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, খুচরা বাজারে দাম বেড়ে প্রতিহালি ডিম ৪৫-৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এতে গত এক মাসে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। সংস্থাটির মতে, ব্রয়লার মুরগি ১৯০-২০০ টাকায় অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এ ছাড়া মুদিপণ্যের বাজারে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকায়, যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি। মাছ-মাংস বিক্রি হচ্ছে আগের দামে। সবজির বাজারে দাম কমে প্রতিকেজি টমেটো ২০-২৫ এবং শসা ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাস্তবে প্রায় সব পণ্যই টিসিবির নির্ধারিত মূল্য থেকে বেশী দরে বিক্রি হচ্ছে ।
এ ব্যাপারে সিলেটের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা আবু সালেহ মোঃ হুমায়ূন কবির দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা প্রতিদিনই সিলেটের বাজার মনিটরিং করে আসছি। বৃহস্পতিবারও আমরা কয়েকটি বাজারের ব্যবসায়ী ও খামারিদের সাথে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে, মুরগির খাদ্য ও ওষুধপত্রের অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি ডিম ও মুরগির উপর পড়েছে। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির বাচ্চা প্রতি দাম বেড়েছে ৩৫ টাকা পর্যন্ত।
তিনি বলেন, বাজার মনিটরিং করে দেখেছি বিভিন্ন স্থানের দামের পার্থক্য দেখা গেছে। আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। আমরা পরামর্শ দিয়েছি উৎপাদন খরচ পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয়ভাবে ডিম ও মুরগির দাম নির্ধারণ করা হলে বাজারে অস্থিরতা থাকবেনা। অন্যথায় বিভিন্ন বাজারে দামের পার্থক্য থাকবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম নিয়ে আমার দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। আমরা প্রতি মাসে একটা মনিটরিং রিপোর্ট কেন্দ্রে প্রেরণ করি। গেল জানুয়ারী মাসেও আমি একটি রিপোর্ট পাঠিয়ে এসেছি। পর্যবেক্ষণে আমি দেখতে পেয়েছি সিলেটে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা খামার তুলনামূলক কম। চাহিদার তুলনায় স্থানীয়ভাবে মুরগি ও ডিম উৎপাদন খুবই কম।
তিনি বলেন, সিলেটে মুরগি ও ডিমের দাম বৃদ্ধির কারণ পর্যবেক্ষণে আমি ৩ টি প্রধান কারণ খুঁেজ পেয়েছি। প্রথমত- স্থানীয়ভাবে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের উৎপাদন কম। ফলে অন্য জেলা থেকে আমদানী করতে গিয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত- পোল্ট্রিজাত খাদ্য ও ওষুধের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয়ত- সিলেটে একটা মধ্যসত্বভোগী শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা স্থানীয় খামারিদের পাশাপাশি ও অন্য জেলা থেকে আমদানী করা মুরগি মজুত করে থাকে। তাদের মাধ্যমে মুরগি ও ডিম বাজারে যাওয়ায় এর প্রভাব বাজারে পড়ে। ফলে দাম তুলনামূলকভাবে বেশী বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।