৩০ কোটিতে থমকে আছে ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ৩:০০:১৬ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : তুরস্ক-সিরিয়ার ভয়াবহ ভুমিকম্পে বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে হতবাক বিশ^। একই সাথে গত কয়েকদিন থেকে পাশর্^বর্তী বিভিন্ন দেশে মৃদু ভুকম্পন অনুভূত হচ্ছে। এমন অবস্থায় সংশয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের মানুষ আছেন চরম ঝুঁকিতে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় থমকে আছে নগরীর ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষার কাজ। এজন্য দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে ৩০ কোটি টাকার চাহিদাপত্র প্রেরণ হলেও সাড়া দিচ্ছেনা মন্ত্রণালয়। এমনটাই জানিয়েছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী।
দেশে ভূমিকম্পের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে সিলেট। ভূ অভ্যন্তরে একাধিক স্থানে ফল্ট সক্রিয় থাকায় সিলেটকে ভূমিকম্পের ‘ডেঞ্জার জোন’ বলে অভিহিত করেন বিশেষজ্ঞরা। গত ২ বছরে সিলেটে অন্তত ১৫ বার ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি থাকলেও মোকাবেলায় সিলেটে নেই কার্যকর উদ্যোগ। মোকাবেলার প্রস্তুতিতে সংশয় থাকায় আতংকে সিলেটের মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ ও ২২ সালে কয়েকদফা ভূমিকম্পের পর ঝুঁকি মোকাবেলায় কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। ভূমিকম্পের ক্ষতি কমাতে ২০২১ সালের মে মাসে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়া সিলেটের ৬টি বিপণিবিতান বন্ধ করে দেয় সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)। এগুলো ভেঙে ফেলা হবে বলেও সেসময় জানিয়েছিল সিসিক। তবে ভেঙে তো ফেলা হয়নিই, উল্টো কিছুদিন বন্ধ থাকার পর ফের খুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানগুলো।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সংগঠিত ভূমিকম্পের অন্তত ২০টির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে। যার মধ্যে ১১টি হচ্ছে সিলেট অঞ্চলে। বাকি ৭টি ছিল সীমান্ত এলাকাসহ আশপাশের দেশগুলোতে। বিশেষজ্ঞরা জানান, বারবার ভূমিকম্প হওয়ার অর্থ এখানকার চ্যুতির লাইনগুলো সক্রিয় আছে।
এদিকে আটকে আছে সিলেটের ৪২ হাজার বহুতল ভবনের ভূমিকম্পের সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগও। সিসিক কর্মকর্তারা জানান, অর্থের অভাবে ভবন পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না।
ফলে এখন পর্যন্ত তর্জন গর্জনেই আটকে আছে ঝুঁকি মোকাবেলার উদ্যোগ। এতে সিলেটে ভূমিকম্পে ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়ছে। সম্প্রতি তুরষ্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর আবার আলোচনায় উঠে এসেছে সিলেটের ঝুঁকির বিষয়টি।
২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর ৬ দফা ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিকম্পে ক্ষতি কমিয়ে আনতে নগরীর সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নগরীর বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করানো হয়।
বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম সদস্য শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বিগত সময়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে সিসিকের নেয়া উদ্যোগে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। আমরা সিসিক প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। একটি প্রস্তাবনা তৈরী করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। কিন্তু আজ অবধি মন্ত্রণালয় থেকে কোন চিঠি না আসায় উদ্যোগটি আলোর মূখ দেখছেনা। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে ধীরগতি কোনভাবেই কল্যাণকর নয়।
তিনি বলেন, সেই সময়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে সিলেটের নতুন ভবনগুলো পরিকল্পিত হলেও পুরনো ভবনগুলো অপরিকল্পিভাবে গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধকভাবে নির্মাণ না হওয়ায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই এসব বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে। দুই-চারটি ভবন নয় বরং নগরীর সবগুলো ভবন একসঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন ভেঙে না ফেলে রেক্টোফিটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। আমাদের পরামর্শে নগরীর রাজা ম্যানশন রেক্টোফিটিং করেছে। যদিও তাদের রেক্টোফিটিং সঠিক হয়েছি কিনা সেটা এখনো পরীক্ষা হয়নি।
জানা গেছে, বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষার পর ২০২১ সালের ৩০ মে নগরীর ২৫ টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করে সিসিক। ওইদিনই নগরীর সুরমা মার্কেট, সিটি সুপার মার্কেট, মধুবন সুপার মার্কেট, সমবায় মার্কেট, মিতালী ম্যানসন ও রাজা ম্যানসন নামের ৭টি বিপণিবিতানকে ১০ দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। তখন নগরীর প্রায় ৪২ হাজার বহুতল ভবন পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)। কিন্তু অর্থ সংকটে সেই উদ্যোগ আর আলোর মূখ দেখেনি। অপরদিকে নির্ধারিত ১০ দিন পর কোনো সংস্কার ছাড়াই খুলে দেয়া হয় বন্ধ করা ভবনগুলো। এখনও এসব ভবনে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আমরা ১০টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছিলাম। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে এগুলো সংস্কার করার জন্যও আমরা মালিকপক্ষকে বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা শোনেননি। আবার ভবনগুলো ভাঙতে গেলে তারা আদালতে মামলা করে বসেন।
তিনি বলেন, আমরা নগরীর ৪২ হাজার ভবনে ভূমিকম্পের সহনীয়তা নিয়ে প্রকৌশলগত বিস্তারিত মূল্যায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ জন্য ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপও করেছিলাম। ঐ প্রতিষ্ঠানটি চারতলা একটি ভবন মূল্যায়নের জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ফি চায়। সেই হিসেবে সব মিলিয়ে নগরীর ৪০ থেকে ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করাতে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে এই খাতে এত বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করার মতো তহবিল নেই। তাই এখনও আমরা এ ব্যাপারে কোনো চুক্তি করতে পারিনি। সিটির বর্ধিত নতুন এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। নতুন কোন বরাদ্দ না পাওয়ায় চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ ঠিকমতো পরিচালনা হচ্ছেনা। এমতাবস্থায় সিসিকের পক্ষে এই টাকা খরচ অসম্ভব।
তিনি আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ভবন পরীক্ষার টাকা সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকদেরই দেওয়ার কথা। কিন্তু কেউই টাকা দিতে রাজি হচ্ছে না। ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় নেয়া সকল উদ্যোগ ভেস্তে যায়। তবে ভবন পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চেয়ে দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র প্রেরণ করেছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোন সাড়া মিলছেনা। মন্ত্রণালয় থেকে এই বরাদ্দ নিশ্চিত হলে আমরা ভবন পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবো।
সিসিক সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে আরেকবার নগরীর বহুতল ভবনগুলোর ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখনও মাঝপথেই আটকে যায় সে উদ্যোগ। নগরীর ৪২ হাজার ভবন পরীক্ষা করা গেলে কয়েকশত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এগুলো ধসে পড়ে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।