চিকিৎসায় দুঃসংবাদ!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০১:১০ অপরাহ্ন
দেশের স্বাস্থ্যখাত যখন নানা সমস্যায় জর্জরিত এমনকি অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও হাসপাতালে এক্সরে মেশিনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও ওষুধপত্রের মারাত্মক সংকট বিরাজ করছে, তখন দেশে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ ৯০ শতাংশেরও বেশী কমেছে। সম্প্রতি একটি জাতীয় মিডিয়ায় এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
জানা গেছে, দেশে ওষুধের জোগানের ৯০ শতাংশেরও বেশী সরবরাহ করে স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানীগুলো। বাকী যেটুকু বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেগুলো প্রধানতঃ ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনী ও ¯œায়বিক বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। জটিল পরিস্থিতিতে রোগীর জীবন রক্ষায় ব্যবহৃত এসব ওষুধের আমদানিতেও এখন বিরূপ প্রভাব ফেলছে ডলার সংকট। চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারী) অতি প্রয়োজনীয় এসব ওষুধের আমদানি কমেছে ৯১ শতাংশ। ওষুধের পাশাপাশি হ্রাস পেয়েছে কাঁচামাল আমদানি। একই সঙ্গে কমেছে ওষুধ শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও। আমদানীকৃত ওষুধ ও উপকরণের অভাবে এখন জটিল অস্ত্রোপচারও হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের বক্তব্য হচ্ছে বাজারে এখন আমদানিকৃত যেসব ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোরও দাম অনেক বেড়েছে। এসব পরিস্থিতি চলমান থাকলে আগামী জুন-জুলাই নাগাদ প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট তীব্র হওয়ার পাশাপাশি জটিল অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে যাওয়ারও আশংকা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থ বছরের প্রথম ৭ মাসে দেশে মোট ওষুধ আমদানির এলসি খোলা হয়েছিলো ৫৩৬ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। চলতি অর্থ বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছে মাত্র ৪৫ দশমিক ২৩ মিলিয়ন ডলারের এলসি। এ হিসেবে এলসি কমেছে ৯১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বিরাজ করছে একই দশা ওষুধ আমদানির এলসি নিষ্পত্তিতেও। গত বছর কভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন ও কভিড টেস্ট কিট আমদানির প্রভাবও রয়েছে এই সংকটের পেছনে। এছাড়া বর্তমান ডলার সংকট তো আছেই।
দেখা যাচ্ছে, কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে উৎপাদিত ওষুধের দামও এখন বাড়ছে। এক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি হ্রাসের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিও বড় ভূমিকা রাখছে। উল্লেখযোগ্য শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও। গত অর্থ বছরের প্রথম ৭ মাসের তুলনায় চলতি অর্থ বছরের একই সময়ে যন্ত্রপাতি আমদানিতেও খোলা নতুন এলসির সংখ্যা কমেছে ৪০ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত অর্থ বছরের প্রথম ৭ মাসে ১২০ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হলেও চলতি অর্থ বছরে তা মাত্র ৭২ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এ খাতের মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি ও ৩১ শতাংশ কমেছে।
লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, ডলার সংকটে ওষুধের পাশাপাশি এখন ক্যান্সার, কিডনী, চর্মরোগ, হৃদরোগ, ¯œায়বিক ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত মেডিকেল ডিভাইসেরও সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে অভাব দেখা দিয়েছে রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন রি-এজেন্টের (রোগ-নিরীক্ষার বিভিন্ন উপকরণ)। এতে জরুরী বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন বন্ধের পথে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ভাষ্য হলো, বিদেশ থেকে পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুতকৃত যেসব ওষুধ আমদানি করা হতো তা এখন প্রায় বন্ধ। এলসি খুলতে না পারায় এমনটি হয়েছে। ডলার সংকটের কারণে ওষুধ আমদানির পরিমাণ কমেছে। দেশে প্রধানতঃ ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনিসহ বেশ কিছু রোগের ওষুধ আমদানি করা হয়। ঘাটতি পড়লে সব ওষুধেরই পড়বে, কোন নির্দিষ্ট ওষুধের পড়বে না। কারণ ওষুধ প্রস্তুতে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৮৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে এখন এলসি খুলতে চায় না ব্যাংক। এখন যে কাঁচামাল আছে, সেটুকু দিয়ে সর্বোচ্চ ৩ মাস চলা যাবে। দুই আড়াই মাস ধরে প্রয়োজনীয় অংকের এলসি খুলতে পারছেন না কাঁচামাল আমদানিকারকরা। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বে পেট্রোকেমিক্যালের দামের উর্ধ্বগতি। এছাড়া তুরস্কের বর্তমান অবস্থাও খারাপ। সর্বোপরি বৈশ্বিক অবস্থা ভালো নয়। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। এছাড়া ডলারের সংকট রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কাঁচামালের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আমরা খারাপ পরিস্থিতির কথা জানিয়েছি। এলসি খুলতে চায় না ব্যাংক। আমরা প্রাইভেট ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে খুলতে চায় না। দুই মাসের মতো সময় ধরে চাহিদা অনুযায়ী এলসি খোলা যাচ্ছে না। আগামী মাস থেকে সংকট তীব্র হওয়ার আশংকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জীবন রক্ষাকারী মেডিক্যাল ডিভাইস চাহিদা অনুযায়ী আমদানি করতে না পারায় হৃদরোগের অস্ত্রোপচার আগের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। এতে হৃদরোগে আক্রান্তদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে। মানবদেহের হৃদযন্ত্রের ভালভ্ রক্ত সঞ্চালনকে স্বাভাবিক রাখে। এ ভালভ্ অকেজো হয়ে পড়লে অকার্যকর হয়ে পড়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ হৃদযন্ত্র। তখন কৃত্রিম ভালভ্ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বর্তমানে আমদানি নির্ভর এ ভালভের সংকট খুব বেশী। একই সঙ্গে সংকট দেখা দিয়েছে অস্ত্রোপচারকালে হৃদযন্ত্রের রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখার অক্সিজেনেটরের। বলা বাহুল্য এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ডিভাইস বা যন্ত্রপাতিসহ এসবের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের তীব্র সংকট বিরাজ করছে অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, এমনকি অনেক হাসপাতালে। জানা গেছে শুধুমাত্র সিলেট জেলার ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই এক্সরে মেশিন নষ্ট। এ অবস্থায় মেডিকেল ডিভাইস এবং সরঞ্জামসহ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও এর কাঁচামাল আমদানির ব্যাপারে সরকারের অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এলসি খোলার ক্ষেত্রে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বা শিথিল করা আবশ্যক। যেহেতু এক্ষেত্রে মানুষের জীবন মৃত্যুর বিষয়টি জড়িত, তাই এ বিষয়ে এখনি সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী। আমরা এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশেষভাবে সরকারের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করছি।