ক্ষতিকর বিকীরণ প্রসঙ্গে
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০১:৪৫ অপরাহ্ন
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনে অনেক আশীর্বাদ নিয়ে এলেও এর কিছু খারাপ দিক ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে, একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কার সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মোবাইল ইন্টারনেট ইত্যাদি। কিন্তু এই যুগান্তকারী ও অতীব উপকারী প্রযুক্তি যে মানুষের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে তা অনেকেই জানেন না। দীর্ঘ দিন ধরে মোবাইল ও মোবাইল টাওয়ার থেকে নিঃসরিত রেডিয়েশন অর্থাৎ তেজোষ্ক্রিয়তা বিকীরণের বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহলে আলোচনা সমালোচনা চলছে। সাম্প্রতিককালে এর সাথে যুক্ত হয়েছে ওয়াইফাই রাউটারের তেজোষ্ক্রিয়তা বিকীরণের প্রসঙ্গ।
উল্লেখ্য, ওয়াইফাই রেডিয়েশন বা রেডিওফ্রিকুয়েন্সি রেডিয়েশন হলো এক ধরণের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন, যা নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন হলেও মানবদেহের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সেই কারণেই ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ‘আর এফ’ রেডিয়েশনকে গ্রুপ বি পসিবল হিউম্যান কার্সিনোজেন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা ক্যান্সারের মতো মারণ ব্যাধির পথ প্রশস্ত করে। বিশেষভাবে ওয়াইফাই রাউটার যদি শোবার ঘর বা যেখানে বিছানা রয়েছে, সেই জায়গার খুব কাছাকাছি থাকে, তবে শারীরিক ক্ষতির শংকা বহু গুণে বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, হালকা দেয়াল ভেদ করেও রাউটারের রেডিয়েশন যে কারোর দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেরতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ওয়াইফাই রাউটার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এর আরএফ রেডিয়েশনের ফলে মানুষের দেহে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ ব্যাহত হয়, যে কারণে ঘুম কমে যায়। এমনটি দীর্ঘদিন যাবৎ ঘটলে ‘ইনসোমনিয়া’ অর্থাৎ অনিদ্রার মতো সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠতে পারে। সেই সঙ্গে ঘুম ঠিকমতো না হওয়ার কারণে দেহের অভ্যন্তরেও নানা নেতিবাচক পরিবর্তন শুরু হতে পারে, এতে ছোট বড়ো নানা রোগের খপ্পরে পড়ার আশংকা বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ওয়াইফাই রাউটারকে ২০/২৫ ফুট দূরে রাখাই উত্তম বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এছাড়া মোবাইল স্ক্রিনের নীল আলো ওয়াইফাই রেডিয়েশনের মতোই মেলাটোনিন নিঃসরণকে প্রভাবিত করে।
এছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল টাওয়ারের অনেকগুলো ক্ষতিকর দিক রয়েছে। জনবসতির মধ্যে মোবাইল টাওয়ার যে বিকীরণ ছড়ায় তার খারাপ প্রভাব পড়ে মানুষের মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রে। মোবাইল থেকে নির্গত রশ্মি বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড যে কোন প্রাণের জন্য কতোটা ক্ষতিকর এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। অনেকের মতে, মোবাইল টাওয়ারের বিকীরণ থেকে মানবদেহে অবসাদ, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা, ঝিমুনি ভাব, মনো সংযোগে সমস্যা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মাথা ব্যাথা, হজম শক্তি হ্রাস, হৃদ স্পন্দন বেড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
এমনকি মোবাইল ব্যবহার না করেও টাওয়ারের বিকীরণের শিকার হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীরা। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে পশুপাখির ওপরও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিগত ২০২১ সালে এক সতর্ক বার্তায় বলেছিলো, মোবাইল টাওয়ারের বিকীরণ থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। দশ বছর ধরে ৩টি দেশে করা তাদের এক সমীক্ষা বলছে, দিনে মাত্র এক-দু’ঘন্টা মোবাইল ফোনে কথা বললেই গ্লিয়োমা (মস্তিষ্কের টিউমার) হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সেই সঙ্গে যত্রতত্র বসানো মোবাইল টাওয়ারগুলোর বিকীরণও বিপদ ডেকে আনছে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় জানা গেছে, এদেশে ব্যবহৃত টাওয়ারগুলোর রেডিয়েশনের মাত্রা আন্তর্জাতিক মাত্রার চেয়ে বেশি। তাই স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে টাওয়ারের রেডিয়েশনের বর্তমানে যে মাত্রা রয়েছে তা দশ ভাগের এক ভাগ কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে। প্রতিবেশি দেশ ভারতে মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি রেডিয়েশন নির্গত হলে ২০ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরণের কোন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেই। ফলে রেডিয়েশন নিয়ে মোবাইল কোম্পানীগুলোও প্রায় নির্বিকার, উদাসীন। এর সাথে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দাবি, পরীক্ষায় মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণা প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করেন। আমরা এ দিকে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উর্ধতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।