প্রতিবাদের প্রতীক ফুলপরী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০১:৪২ অপরাহ্ন
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেত্রীর হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত ছাত্রী ফুলপরী খাতুনের ঘটনা এখনো ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় এবং সচেতন মহলে। ঘটনাটি এখন শুধু দেশেই নয়, প্রবাসী বাংলাদেশী ও অন্যান্য কমিউনিটির মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় সবাই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং এখনো জানাচ্ছেন।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারী দেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় ইবিতে ছাত্রলীগ নেত্রীর নেতৃত্বে ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের অভিযোগ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের এক নবীন ছাত্রীকে রাতভর র্যাগিং করার অভিযোগ ওঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নেত্রী ও শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ঐ ভুক্তভোগী ছাত্রী। ভুক্তভোগী ঐ ছাত্রী ফুলপরী খাতুন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। হলের গণরুমে ডেকে নিয়ে ঐদিন রাত ১১ টা থেকে রাত সাড়ে ৩ টা পর্যন্ত তাকে মারধর, হেনস্তা, শারীরিক নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারনের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।
এ ঘটনার সংবাদ প্রকাশ হলে এবং ভুক্তভোগী ছাত্রী অভিযোগ করলে নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেত্রী ও তার অনুসারীরা পাল্টা বিক্ষোভ করে এবং ভুক্তভোগী ছাত্রী ফুলপরীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে হলের প্রোভেস্টের কাছে একটি লিখিত আবেদনপত্র দাখিল করে। তারা ফুলপরীকে বহিষ্কারের দাবি জানায়।
লিখিত অভিযোগে ওই ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, ফিন্যান্স বিভাগের তাবাচ্ছুম রাতে তাকে কক্ষে দেখা করতে বলেন। অসুস্থ থাকায় দেখা করতে না পারায় পরে তারা তার উপর চড়াও হয় এবং তাদের রুমে গিয়ে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। রোববার রাত ১১ টায় অন্তরাসহ তার সঙ্গে থাকা ৭-৮ জন গণরুমে নিয়ে গিয়ে চড় থাপ্পড় মারতে থাকে। এর প্রতিবাদ করলে তারা তার মুখ চেপে ধরে এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারে। ভয়ে কেঁদে তাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা ওই ছাত্রীকে লাথি মারে এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এক পর্যায়ে তাকে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখে। একটি ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেয়। এছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রী ফুলপরীকে বিবস্ত্র করে সেটার ভিডিও ধারণ করে ঐ নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেত্রী ও তার সঙ্গ[ীরা।
উপরের এই ঘটনাটি অভাবনীয় এবং বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। বুয়েটের ছাত্র সেই আবরারের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড কিংবা ভিকারুন্নেসা নুন কলেজে শিক্ষার্থী নির্যাতন থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদের নির্যাতন করে আইসিইউতে পাঠানোর ঘটনা এবং শেষ পর্যন্ত ফুলপরীকে নির্যাতনের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একশ্রেণীর নেতানেত্রীর সীমাহীন নিষ্ঠুরতা, দুর্বৃত্তপনা ও অপরাধ-অপকর্ম। ফুলপরীর সাথে যে আচরণ করা হয়েছে, তা এখন আর বড় কোন ঘটনা নয়। ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি, র্যাগিংয়ের নামে অপমান, লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের বহু ঘটনা ইতোপূর্বে ঘটেছে। কোনটা প্রকাশিত হয়েছে, কোনটা প্রকাশিত হয়নি। এসব অপরাধের মোটা দাগে কোন বিচার হয়নি। বরং দেখা গেছে, ইডেন কলেজে যেসব ছাত্রী ছাত্রলীগ নেত্রীদের অপরাধের প্রতিবাদ করেছিলেন, তারা মামলার শিকার হয়েছেন। ছাত্রীদের দিয়ে জোরপূর্বক মনোরঞ্জন করানোর কাজ এক ছাত্রী সাহস করে ফাঁস করার পর তার ওপর নেমে আসে, হয়রানি-নির্যাতন। এমনকি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে আটক করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে বলে ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন। এভাবে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত সারাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেপরোয়াভাবে শিক্ষার্থী নির্যাতন করছে। এক্ষেত্রে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। ভয়ে বা স্বার্থে তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ কিংবা ক্ষমতাসীন মহল এসবের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে কাজ হতো, প্রতিকার মিলতো। ছাত্রলীগের এভাবে বেপরোয়া হওয়ার পেছনে নাগরিক সমাজ কম দায়ী নয়। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের কথা বাদ দিলেও অন্তত: নারী নির্যাতনের ঘটনায় নারী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরও প্রতিবাদ দূরে থাক, মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে দেখা যায়। বর্তমান সময়ে নারী অধিকার রক্ষাকারী, মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিও নেতারাও প্রায় চুপ। অবস্থা যখন এমন তখন ইবিতে নির্যাতিতা পাবনার এক দরিদ্র ভ্যান চালকের মেয়ে শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের ঘটনাটি একটি প্রতিবাদের ব্যতিক্রমি সাহসী ঘটনা।
শিক্ষাঙ্গনে নির্যাতন, নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ফুলপরীর এই অসাধারণ প্রতিবাদী ভূমিকা জাহেলিয়াতের অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হয়ে পথ প্রদর্শন করুক, এমন প্রত্যাশা সকল বিবেকবান মানুষের মতো আমাদেরও।